ইমরান খান থেকে বেনজির ভুট্টো

পাকিস্তানের যে প্রধানমন্ত্রীদের ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১১ পিএম, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
পাকিস্তানের সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ/ ছবি: টোয়েন্টি ফোর নিউজ

সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর ‘ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনসের’ (আইএসপিআর) ডিরেক্টর জেনারল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ আখ্যা দেওয়া দেশটিতে নতুন কিছু নয়। সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার টানাপোড়েনের ইতিহাসে এই অভিযোগ বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) রাওয়ালপিন্ডিতে দীর্ঘ দুই ঘণ্টারও বেশি সময়ের সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খানকে তিনি ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’, ‘বিভ্রান্ত’ ও ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি’ বলে আখ্যা দেন। এই সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খানের বিরুদ্ধে তার কড়া ভাষা পাকিস্তানের রাজনীতির জটিল বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

এবারই প্রথম নয়

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনীতিবিদ, সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত ছিল অব্যাহত। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ব্যাহত হওয়ার এই পরিস্থিতিতে নিয়ত সরকার বদলেছে, ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী।

ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় রাজনীতিবিদদের ‘সামাজিক কীটপতঙ্গ’, ‘জোঁক’ ও ‘হাঙ্গর’ পর্যন্ত বলে আক্রমণ করেছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি রাজনৈতিক নেতাদের অযোগ্য ঘোষণার জন্য প্রণয়ন করেছিলেন ‘ইলেক্টিভ বডিস ডিস্‌কোয়ালিফিকেশন অর্ডার’, যা মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিল।

ফাতিমা জিন্নাহ থেকে বেনজির ভুট্টোও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন

আয়ুব খান শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহকেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাকে দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্রের অংশ বলেও প্রচার করা হয়েছিল।

জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয় ও তার মেয়ে বেনজির ভুট্টোকেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এমনকি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পর্যন্ত বলেছিল, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে বেনজিরকে বিশ্বাস করা যায় না।

সমাজকর্মী ও ইতিহাসবিদ আম্মার আলী জানের মতে, পাকিস্তানের ইতিহাসে কখনো বাঙালি জনগোষ্ঠী, কখনো ভুট্টো পরিবার, কখনো ফাতিমা জিন্নাহ- প্রায় সবাইকেই কোনো না কোনো সময় ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

নওয়াজ শরীফকেও দেওয়া হয়েছে এক তকমা

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আগে থেকেই এই টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল।

২০২০ সালে ভিডিও ভাষণে নওয়াজ বলেন, যারা সংবিধান ভাঙে তারা দেশপ্রেমিক, আর আমরা যারা নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা, আমরা নাকি দেশদ্রোহী!
তার পরেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এমনকি, তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজের হোটেল রুমে হানা ও পরে তাকে হুমকির ঘটনায় তিনি সেনাপ্রধান ও আইএসআই প্রধানকে সরাসরি দায়ী করেন।

এবার ইমরান খান

ইমরান খানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষোভ জমতে থাকে ২০২২ সালে, তার সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে। সেনাপ্রধান বাজওয়াকে ‘মীর জাফর’,‘মীর সাদিক’ বলা ও অনাস্থা ভোটের আগে সেনাবাহিনীর প্রকাশ্য সমালোচনা, সব মিলিয়ে উত্তেজনা দ্রুত বাড়ে।

ওব বছরের ৯ মে’র ঘটনার পর পরিস্থিতি আরও বিস্ফোরক হয়। পরবর্তী সময়ে পিটিআই নেতাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক বাতিল, বোনসহ পরিবারের সদস্যদের দেখা করার অনুমতি না দেওয়া- সবই ইঙ্গিত দেয় সম্পর্কের চরম অবনতির। আর পাকিস্তান আইএসপিআরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে স্পষ্ট যে ইমরান খানের সঙ্গে সামরিক প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে।

একই ‘তকমা’ বারবার, প্রশ্ন উঠছে গণতন্ত্র নিয়ে

ইতিহাসবিদ আম্মার আলী জান বলেন, এক সময় যাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হয়েছে, পরেই তারা দেশপ্রেমিক হয়ে যান। এ শুধু এক ধরনের রাজনৈতিক সিনেমা, যা জনগণকে বারবার দেখানো হয়।

তার মতে, সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো- কে নিরাপত্তা হুমকি আর কে নয়, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে আইএসপিআরের হাতে থাকা উচিত নয়।
কারণ, জনগণের ভোটেই ঠিক হয় কে নেতৃত্ব দেবে; সামরিক প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তে নয়।

আম্মার আলীর ভাষ্য, যদি তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে থাকেন, তাহলে একসময় আপনারা (সেনাবাহিনী) কেন তাদের সমর্থন করেছিলেন? কেন সরকারে এনেছিলেন?

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।