দেহে অ্যান্টিবডি না থাকলেও সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব?
সাধারণভাবেই আমরা জানি যে একবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতেই দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় ফলে দেহ করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ওঠে।
সোজা কথায়, আপনার দেহে এ্যান্টিবডি থাকলেই আপনি করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারবেন। এর আগে নয়। কিন্তু নতুন এক জরিপে আভাস পাওয়া গেছে যে, যাদের দেহে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়নি তাদের দেহেও এই ভাইরাস প্রতিরোধের কিছুটা ক্ষমতা থাকে।
সুইডেনের কারোলিনস্কা ইন্সটিটিউটের একটি জরিপের পর গবেষকরা বলছেন, এই প্রতিরোধ ক্ষমতা আসে ‘টি-সেল’ নামে রক্তে থাকা এক ধরণের কোষ থেকে। এর কাজ কোন দেহকোষে সংক্রমণ হলেই তাকে আক্রমণ করে ধ্বংস করা।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে করা গবেষণায় এতদিন বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে অ্যান্টিবডির দিকেই। কিন্তু এখন এর বাইরেও অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
অধ্যাপক মার্কাস বাগার্ট বলেন, অ্যান্টিবডি হচ্ছে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো দেখতে একটা প্রোটিন যা ঠিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে একটা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার মতো করেই কাজ করে।
করোনাভাইরাস মানুষের দেহকোষে ঢোকার আগেই এই অ্যান্টিবডি ভাইরাসের সাথে আটকে গিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
আর যদি অ্যান্টিবডি এটা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে করোনাভাইরাস দেহকোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেটাকে আরও ভাইরাস তৈরির কারখানায় পরিণত করে।
তবে টি-সেল কাজ করে একটু অন্যভাবে। এই সেলগুলো ইতোমধ্যেই সংক্রমিত হয়েছে এমন দেহকোষগুলোকে টার্গেট করে এবং সেগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। ফলে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে অন্য সুস্থ কোষ আক্রান্ত হতে পারে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, টি-সেলের এক ধরনের স্মৃতিশক্তি রয়েছে। তারা ভাইরাসটাকে চিনতে পারলেই এটা কোন কোন কোষগুলোকে সংক্রমিত করেছে তা টার্গেট করে সেগুলো ধ্বংস করতে থাকে।
২শ জনের ওপর নতুন এই গবেষণা চালানো হয়েছে। তাদের দেহে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল দুটোই আছে কিনা সেটাই পরীক্ষা করা হয়েছিল।
দেখা গেছে, প্রতি একজন অ্যান্টিবডি-বিশিষ্ট ব্যক্তির বিপরীতে দু’জন করে লোক পাওয়া যাচ্ছে যাদের রক্তে এমন টি-সেল আছে - যা সংক্রমিত দেহকোষ চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করে ফেলতে পারে।
এর মধ্যে এমন লোকও আছে যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু তাদের উপসর্গ ছিল খুবই মৃদু বা আদৌ কোন উপসর্গ দেখা যায় নি।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের অথ্যাপক ড্যানি অল্টম্যান বলছেন, এটা একটা চমৎকার গবেষণা যাতে আবারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, মানুষের করোনাভাইরাস-প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যাপারটা শুধু অ্যান্টিবডি টেস্ট দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
এই গবেষকরা বলছেন, তারা যে ২শ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছেন তাতে কয়েকজন রক্তদাতা আছেন। আরও আছেন সুইডেনে প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন এমন কিছু লোক।
এদের অনেকে উত্তর ইতালিসহ কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়েছে এমন জায়গা থেকে সুইডেনে ফিরেছিলেন। এর অর্থ হলো, অ্যান্টিবডি পজিটিভ হয়ে কোভিড-১৮ প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করেছেন এমন লোকদের যে সংখ্যা সরকারি হিসেবে বলা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি লোকেরই হয়তো এ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে।
তারা হয়তো দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও অসুস্থ হবেন না। কিন্তু তাদের থেকে অন্যদের দেহে রোগ ছড়াতে পারে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, টি-সেল করোনাভাইরাসকে সম্পূর্ণ আটকে দিতে পারে কিনা এটা এখনো অজানা। অথবা এমনও হতে পারে যে তারা হয়তো একজন লোককে করোনাভাইরাসে অসুস্থ হতে দেয় না - কিন্তু তিনি ভাইরাসটা বহন করতে পারেন এবং অন্যদের মধ্যে ছড়াতেও পারেন।
এটা জানার জন্য জন্য আরো বিশ্লেষণ প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ ৬০ জন রোগীর ওপর এক গবেষণা চালিয়েছে ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট, কিংস কলেজ লন্ডন এবং গাইজ এ্যান্ড সেন্ট টমাস হসপিটাল।
তারা দেখেছেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীর দেহে টি-সেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়। কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের জরিপে কিন্তু দেখা গেছে, কোভিড-১৯ রোগীরা যত বেশি অসুস্থ তাদের দেহে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল ততই বেশি।
এই দলটি বলছে, এ ব্যাপারে আরও গবেষণা দরকার। উল্লেখ্য, টি-সেল অত্যন্ত জটিল, বিশেষ ধরণের ল্যাবরেটরি ছাড়া এটা নিয়ে গবেষণা করা যায় না।
মানবদেহে টি-সেল উৎপাদন বাড়ায় এমন একটি ওষুধ হচ্ছে ইন্টারলিউকিন-সেভেন। এটি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে সেরে উঠতে সাহায্য করে কিনা তা নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
টিটিএন/জেআইএম