করোনার কালো থাবায় কন্যা শিশুরা
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ভারতে লকডাউন জারি করা হলে তা শিশুদের জন্য বিভীষিকা হিসেবে হাজির হয়। দেশটিতে লকডাউন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে শিশুদের ওপর। দীর্ঘদিনের লকডাউনে ভারতে বাল্যবিয়ে, শিশু শ্রমের ঘটনা নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পোয়। বিবিসির দিব্য আর্য এক প্রতিবেদনে করোনার লকডাউন শিশুদের ওপর কীভাবে যন্ত্রণা বয়ে এনেছে সেই চিত্র তুলে ধরেছেন।
জীবনের প্রথম লড়াইয়ে জিতে গেছেন ওডিশ্যার ১৩ বছর বয়সী শিশু রানি। এই গ্রীষ্মে বাবা-মা রানিকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রানি বিয়ে ঠেকাতে সহায়তা চায় এবং সফলও হয়। গত মার্চে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ভারত সরকার দেশজুড়ে লকডাউন জারি করে। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য।
রানি (এটা তার আসল নাম নয়) অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। লকডাউনের এক মাসের মাথায় রানির যক্ষ্মা আক্রান্ত বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করে। রানির মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, আমি বুঝতে পারছি না কেন সবাই শিশুদের বিয়ে করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা বুঝতে পারে না- স্কুলে যাওয়া, উপার্জন করতে শেখা এবং স্বনির্ভর হতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আইন অনুযায়ী, ভারতে ১৮ বছরের কমবয়সী শিশুদের বিয়ে বৈধ নয়। কিন্তু জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের রেকর্ড ভারতে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাল্যবিয়ের ঘটনা দেশটির দখলে। ভারতে প্রত্যেক বছর প্রায় ১৫ লাখ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়।
তবে চলতি বছরে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ হতে পারে। ভারতে শিশুদের সহায়তাদানকারী সংস্থা চাইল্ডলাইন বলছে, গত বছরের জুন ও জুলাইয়ের চেয়ে চলতি বছরের একই সময়ে দেশটিতে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পেতে তাদের কাছে আসা কন্যাশিশুদের টেলিফোন প্রায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্চ থেকে জুনের শুরুর দিক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের লকডাউনে ভারতে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন। বেকারদের বেশিরভাগই দেশটির অনানুষ্ঠানিক ও অরক্ষিত খাতের কর্মী। দেশটিতে এই বেকাররা ভয়াবহ দারিদ্রতায় নিমজ্জিত হয়েছেন।
দেশটির সরকারি তথ্য বলছে, লকডাউনের সময় কর্ম হারিয়ে গ্রামে এবং নিজ শহরে ফিরেছেন কয়েক কোটি মানুষ। যাদের বেশিরভাগই তরুণ। যে কারণে অল্পবয়সী মেয়েদের বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত। মেয়েদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিয়ে দেন।
এছাড়া অন্য আরেকটি কারণ হলো- বিশাল বিয়ের আয়োজনের জন্য মেয়েদের বাবা-মা অর্থ দেন ছেলেপক্ষকে। কিন্তু করোনা বিধি-নিষেধের কারণে বিয়ের আয়োজনের আকার ছোট হয়ে আসায় অর্থ-সাশ্রয়ের কথাও চিন্তা করেছেন তারা।
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ মহারাষ্ট্রের উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের সহকারী কমিশনার মনিশা বিরারিস বলেন, এসব কারণে যে বাবা-মায়েরা লকডাউনের সময় মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন, তা সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। এটা ছিল সহজ এবং সাশ্রয়ী বিয়ের সুযোগ। কারণ তারা অল্প কিছু মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রক্ষা পেয়েছেন।
জনু মাসে দেশটি ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করলেও অনেকেই এখনও তাদের কর্মে ফিরতে পারেননি। অর্থনীতি এখনও ধুঁকছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কিশোর-কিশোরীরা এখনও বাড়িতে বন্দি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভারতে পরিবর্তনের ধারক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ওডিশ্যার মতো দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলোর জন্য; যেখানে রানি বসবাস করেন। এখানে কন্যা শিশুরা যখন পরিবার থেকে বিয়ের চাপের মুখোমুখি হয়, তখন স্কুল শিক্ষক কিংবা সহপাঠীদের কাছে সহায়তার জন্য যেতে পারে।
‘কিন্তু স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাস্থল হারিয়েছে কন্যাশিশুরা। চরম দারিদ্র সম্প্রদায়ে কন্যাদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেয়া হয় না। একবার স্কুল ছাড়া হলে বিরতি দিয়ে আবার স্কুলে ফিরতে পরিবারকে রাজি করানো শিশুদের জন্য কঠিন’- বলছেন ইউনিসেফের বাল্যবিয়ে নিয়ে বিশেষ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত অ্যাকশন এইডের ভারতীয় কর্মকর্তা স্মিতা খানজো।
রানির সবচেয়ে কাছের এক বান্ধবী চলতি বছরের শুরুতে পরিবারের ইচ্ছায় বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু রানি জরুরি জাতীয় হেল্পলাইনের নম্বরে টেলিফোন করে নিজের বিয়ে ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে। স্থানীয় এনজিও, পুলিশ ও চাইল্ডলাইনের সহায়তায় নিজের বিয়ে আটকে দেয় রানি।
কিন্তু রানির সমস্যার শেষ হয়নি এখনও। এর কিছুদিন পর তার বাবা মারা যান। সে বলে, পুনরায় খুলে দেয়া হলে আমি আবারও স্কুলে যেতে চাই। আমার বাবা না থাকায় এখন আমার কঠোর পরিশ্রম করা দরকার। সংসার চালাতে মাকে সহায়তা করাটা আমার দায়িত্ব।
ছেলেদের জন্যও পরিস্থিতি কিছুটা ভয়াবহ। অ্যাকশন এইডের খানজো বলছেন, তিনি এবং তার সহকর্মীদের কাছে প্রতিনিয়ত সারাদেশ থেকে অভিযোগ আসছে, পরিবারকে সহায়তার জন্য কিশোরদের কল-কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করছেন অভিভাবকরা।
ভারতীয় আইনে শিশু শ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু দেশটির সর্বশেষ সরকারি জরিপ বলছে, ২০১১ সালে ভারতের ২৬ কোটি শিশুর মধ্যে অন্তত এক কোটি শিশুশ্রমের সঙ্গে নিয়োজিত।
তবে এটা আসলে পরিবারগুলোর জন্যও সহজ কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না। প্রায় চার মাসের লকডাউনের কারণে নিজের ১৩ বছর বয়সী ছেলেকে একটি চক্রের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন পঙ্কজ লাল। পরিবারে তার পাঁচ সন্তান রয়েছে। লকডাউনের কারণে সবকিছু যখন থমকে যায়, তখন তার রিকশার চাকাও গতি হারায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার আশায় সন্তানকে বিক্রি করে দেন তিনি।
বিহারের বাড়ি থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে রাজস্থানের একটি কারখানায় মাসিক ৫ হাজার রূপিতে কারবারীদের হাতে তুলে দেন ছেলেকে। মহামারির কঠিন এই সময়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এই অর্থ তাদের জন্য যথেষ্ঠ।
ছেলেকে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পঙ্কজ লাল। বলেন, আমার ছেলে দুদিন ধরে কিছু খায়নি। আমি নিজেই কারবারীদের হাতে ছেলেকে তুলে দিয়েছি। তাকে না পাঠিয়ে আমার কোনও উপায়ও ছিল না।
চলাচল ও পরিবহনে ব্যাপক কড়াকড়ি থাকলেও প্রভাবশালী ওই চক্র বিলাসবহুল বাসে করে ভিন্ন রুটে শিশুদের বিহার থেকে রাজস্থানে নিয়ে যায়। পঙ্কজের ছেলে ছাড়াও আরও ছয় শিশুকে বাসে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশি তল্লাশির মুখোমুখি হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে রাজস্থানের একটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সূত্র: বিবিসি।
এসআইএস/এমএস