যেভাবে পরিচ্ছন্ন শহর ইন্দোর

পেছনে রয়েছে শহরবাসীর খুব সাধারণ ৭টি অভ্যাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫০ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কীভাবে একটি জনবহুল শহরকে পরিষ্কার রাখা যায়, সেই পথ দেখিয়েছে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সবচেয়ে বড় ও শহর ইন্দোর। ২০১৭ সালের পর থেকেই শহরটি ভারতের পরিচ্ছন্ন শহরের তকমা পেয়ে আসছে। এখন এটিকে দেখে ভারতের বিভিন্ন শহর তো বটেই, অন্যান্য দেশও ইন্দোর পরিচ্ছনতা নীতি অনুসরণ করার কথা ভাবছে।

তবে কোনো শহরের বাসিন্দারা যদি সচেতন না হয় কিংবা তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস গড়ে না ওঠে, তাহলে এমনটি সম্ভব না। আর এখানেই চমক দেখিয়েছে ইন্দোর পৌর কর্তৃপক্ষ। বাসিন্দাদের মধ্যে সাতটি খুব সাধারণ অভ্যাস ও চারটি সূত্র শহরটিকে পুরো বদলে দিয়েছে। আসুন জেনে নিই কী সেই সাতটি অভ্যাস।

প্রতিদিনের আবর্জনা প্রতিদিন অপসারণ

শুরুতে ইন্দোর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন শহরজুড়ে আবর্জনার বিন স্থাপন করেছিল। তারা আশা করেছিল, বাসিন্দারা নির্দিষ্ট রঙ করা বাক্সে বর্জ্য ফেলবে। কিন্তু এই কৌশল ব্যর্থ হয়। করপোরেশন তখন ঘরে ঘরে আবর্জনা সংগ্রহের কৌশল অবলম্বন করে। আর এই সাধারণ পরিবর্তনটিই শহরের বর্জ্য অপসারণের চিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়।

jagonews24

আরও পড়ুন: কীভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চমক দেখাচ্ছে ইন্দোর?

পৌরসভার কর্মীদের হাতে আবর্জনা হস্তান্তর করার জন্য লোকেরা তাদের বাড়ি ও দোকান পরিষ্কার করতে শুরু করে। তাছাড়া বাসিন্দাদের শুকনা বর্জ্য ও ভেজা বর্জ্য আলাদা রাখতে বলা হয়, যাতে নিষ্পত্তি সহজ হয়।

গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার তৈরি

এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য ইন্দোর পৌর কর্তৃপক্ষ ব্যতিক্রম একটি পন্থা অবলম্বন করে। তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার তৈরির পরিকল্পনা করে। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে ঘাস, লতাপাতা, গোবর ও কার্বন সমৃদ্ধ আবর্জনা শুকনো গাছ বা খড়, বিভিন্ন রকমের ফল এবং শাকসবজির খোসা, ডিমের খোসা, ব্যবহার করা টি ব্যাগ কিংবা গুঁড়ো চা ইত্যাদি।

এতে ধীরে ধীরে ব্যাপক সাড়া মিলতে থাকে। বর্তমানে ইন্দোরজুড়ে ৭০০টিরও বেশি কম্পোস্ট সার তৈরির ইউনিট কাজ করছে।

jagonews24

পলিথিনের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা

পলিথিনকে পরিবেশ দূষণের বড় একটি উপাদান হিসেবে ধরা হয়। তাই ইন্দোর কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের পলিথিন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে থাকে। ধীরে ধীরে শহরবাসীর অভ্যাসে পরিবর্তন আসে।

আরও পড়ুন: যেসব কারণে ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর ইন্দোর

শহরবাসীর সুবিধার জন্য নগর কর্তৃপক্ষ ঝোলা (কাপড়ের ব্যাগ) ব্যাংক স্থাপন করেছে, যেখানে লোকেরা ন্যূনতম মূল্যে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাপড় ও কাগজের ব্যাগের পাশাপাশি একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক ব্যাগ কিনতে পারেন।

গাড়িতেও ডাস্টবিন ব্যবহার

শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ইন্দোরবাসী গাড়িতেও ডাস্টবিন ব্যবহার শুরু করে। এটি একটি অভিনব ধারণা ছিল, যা পুরোপুরি কার্যকর হতে শুরু করে। লোকেরা তাদের গাড়িতে ছোট ডাস্টবিন নিয়ে যেতে শুরু করে, যাতে গাড়ির সৃষ্ট বর্জ্য রাস্তায় না ফেলতে হয়। তাছাড়া যারা পান ও গুটকা চিবিয়ে খায়, তারাও গাড়িতে ছোট্টে ডাব্বা রাখতে শুরু করেন।

jagonews24

শিশুদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি

স্কুলের শিক্ষক ও বাড়িতে অভিভাবকরা শিশুদের খোলা জায়গায় ময়লা ফেলার খারাপ দিক সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নেন। বাড়িতে ও স্কুলে শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব শেখানোর পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা শেখানো শুরু হয়। ধীরে ধীরে ইন্দোরের শিশুরা এখন এতটাই সচেতন হয়ে ওঠে যে যখন তারা কোনো বয়স্ক ব্যক্তিকে রাস্তায় আবর্জনা ফেলতে দেখে, তখন বাচ্চারা তাদের শাসন করার চেষ্টা করে।

অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানস্থল পরিষ্কার করা

পারিবারিক পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার পর, সামাজিকভাবে বিষয়টি ইন্দোরের আদর্শ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে জনসমাবেশ থেকে বিভিন্ন উৎসব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মানুষের মধ্যে অনুষ্ঠানের পুরো জায়গা পরিষ্কার করে রেখে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। আস্তে আস্তে ইন্দোরের বাসিন্দারা তাদের পুরানো মানসিকতা পরিবর্তন করে ও প্রতিটি ইভেন্টের পরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো ‍শুর করে।

আরও পড়ুন: কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সাড়া ফেলেছে ‘নোনা পানি’

দৃঢ় অঙ্গীকার

ইন্দোরে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরবাসীকে পরিচ্ছন্নতায় উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বিবাহের আচারে অষ্টম অঙ্গীকার হিসেবে পরিচ্ছনতা নীতি মেনে চলার বিষয়টি যোগ করে পৌর কর্তৃপক্ষ। নবদম্পতিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শপথ করানো হয় ও বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালে ডাস্টবিন বিতরণ করে পৌর কর্তৃপক্ষ।

jagonews24

চারটি সূত্র

সাতটি অভ্যাস-পরিবর্তন ছাড়াও, ইন্দোর শহরকে পরিষ্কার রাখার জন্য চারটি সূত্রে কাজ করেছে।

আবর্জনার বিন অপসারণ

ইন্দোর কর্তৃপক্ষ দেখতে পায়, আবর্জনার বিনগুলোর আশেপাশে পথ কুকুর, বিড়াল, কাক ইত্যাদি প্রাণী ঘোরাফেরা করে ও সুযোগ পেলে বিনের ভেতরে ঢুকে খাবার খুঁজতে গিজে বর্জ্য ফেলে চারপাশ নোংরা করে ফেলে। এটি দেখার পর ইন্দোর প্রশাসন সব বিন সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ও আবর্জনা সংগ্রহের জন্য পৌরসভার কর্মীদের ঘরে ঘরে পাঠাতে শুরু করে।

নাইট ক্লিনিং

আগে পৌরসভার কর্মীরা ভোরের দিকে সব রাস্তা পরিষ্কার করতেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। তারা সন্ধ্যায় দোকান থেকে আবর্জনা সংগ্রহ ও রাতে বাজার পরিষ্কারের জন্য কর্মী নিয়োগ দিতে শুরু করে। এতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।

নতুন পৌর ট্রাক

ভারতে অন্যন্য শহরে ১ দশমিক ৮ ঘনমিটার ক্ষমতার আবর্জনা সংগ্রহকারী ট্রাক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ইন্দোর পৌর কর্তৃপক্ষ ৩ দশমিক ৩ ঘনমিটার ক্ষমতার ট্রাক ব্যবহার শুরু করে। আগের একটি ট্রাক দিনে ৩০০টি বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করতে পারতো, কিন্তু একটি ইন্দোরিয়ান কন্টেইনার ট্রাক প্রায় ১০০০ বাড়ি কভার করতে পারে।

jagonews24

আরও পড়ুন: কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো ইন্দো-বাংলা নোয়াখালী উৎসব

শিশুদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানো

বলা হয়, কোনো সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে, সবার আগে শিশুদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হয়। ইন্দোর কর্তৃপক্ষ এই কাজটিই করেছে। তারা শিশুদের পরিচ্ছন্নতার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করেছে। শহরের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে স্কুল-কলেজে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে ইন্দোরের দেখাদেখি উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ, কানপুর ও গুজরাটের আহমেদাবাদের মতো শহরগুলো একই পরিচ্ছন্ন নীতি অনুসরণ করছে।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।