করোনা পরিস্থিতি দেখে আদালতের সিদ্ধান্ত : প্রধান বিচারপতি
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ভার্চুয়ালি আদালত চালানোর আইন হওয়াতে কোর্ট পরিচালনা করা যাচ্ছে। তা না হলে কোর্ট বন্ধ করে দিতে হতো বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এখনও ভারত-পাকিস্তানে আইন হয়নি। পাকিস্তানে এখনও ফিজিক্যাল কোর্ট হয়। সবকিছু দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) আপিল বিভাগে মামলার শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।
সরকার ঘোষিত লকডাউন চলাকালীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চ বাড়ানো হবে নাকি সব আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হবে, তা পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দৈনিক পরিস্থিতি দেখছি, পর্যবেক্ষণ করছি। পরিস্থিতির আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ এ সময় তিনি আইনজীবীসহ সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন।
মঙ্গলবার সকালে আপিল বিভাগের মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রধান বিচারপতির কাছে ভার্চুয়ালি হাইকোর্টের বেঞ্চ বাড়াতে মৌখিকভাবে আবেদন করেন। অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে প্রয়োজনে আদালত বন্ধ ঘোষণা করতে বলেন। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা পরিস্থিতি দেখছি। সেটি দেখেই সিদ্ধান্ত নেব।
আপিল বিভাগের তালিকায় থাকা ৪৬ নম্বর আইটেমের শুনানি শেষে আগামীকাল আদেশের জন্য রাখেন আপিল বিভাগ।
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দস কাজল আদালতকে বলেন, ‘যে বিবেচনায় এ মামলাটি কালকে আদেশের জন্য রাখলেন সেই বিবেচনার জন্য প্রত্যেকটা আইনজীবী অপেক্ষা করছেন।’ তখন আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘মিস্টার রুহুল কুদ্দুস এই যে, নির্বাচন করেছেন, এমন অবস্থা করেছেন, এখন সব এফেক্টেড হয়ে গেছে।’
তখন প্রধান বিচারপতিও বলেন, ‘এটি করে বারে এফেক্টেড হয়ে গেছে, বারের প্রেসিডেন্টের তো লাইফ নিয়ে টানাটানি। এরপর আবার করেন পিকনিক। এটা করেন, সেটা করেন। এখন থেকে বার লাইব্রেরি বন্ধ করে রাখেন। সব ভার্চুয়ালি করবেন।’
আইনজীবী রুহুল কুদ্দস কাজল বলেন, ‘মাই লর্ড ভার্চুয়াল কোর্টগুলো খুলে দেন। আমরা ভার্চুয়ালি করি।’ উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এতগুলো পারব না। সবকিছু বন্ধ, আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। শুধু স্পেশাল প্রয়োজনে কিছু কাজ করব।’
আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘মাই লর্ড আপনারা হাইকোর্টে যে লিমিটেড জুরিকডিশন দিয়েছেন, সেখানে ৫ তারিখ থেকে এফিডেফিটকৃত মামলা। দেখা যাচ্ছে, ৫ তারিখের আগের কিছু আর্জেন্ট মোশন জমা ছিল। কিন্তু আপনারা ৫ তারিখ থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়ায় তার আগের কোন আর্জেন্ট ম্যাটার কিন্তু হাইকোর্ট গ্রহণ করতে পারছেন না।’
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের এফিডেফিট কমিশনার ৪ থেকে ৫ জন অসুস্থ। এখন আমি যে কোর্টে স্টাফ নিয়ে আসবো, আমি কি তাদের মেরে ফেলার জন্য নিয়ে আসবো? ৮ থেকে ১০ হাজার মোশন পেন্ডিং আছে। আমি তো এগুলো দিলে বেঞ্চ অফিসাররাও অসুস্থ হয়ে যাবে। জজ সাহেবেরা অসুস্থ হযে যাবে। এখন আমরা কি করবো। তারপরও আমরা বিচার ব্যবস্থাটা খোলা রেখেছি।’
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘মাই লর্ড শুধুমাত্র জরুরিগুলো দেন। পুরানোর মধ্যেও অনেক জরুরি থাকতে পারে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বেইল ম্যাটার প্রত্যেকটা জরুরি। এটা কেমনে বলবেন এটা জরুরি না।’
এ সময় আপিল বিভাগর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘এটা খুলে দেখা যাবে হাজার হাজার ফাইল করতেছে, তখন কী করবেন?’
রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আমরা আইনজীবীরা খুবই অসুবিধার মধ্যে আছি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওই দিন বিচারপতি ওবায়দু হাসান উগান্ডার প্রেসিডেন্টের একটা আর্টিকেল পাঠায়ছেন, সেখানে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, দেশে যুদ্ধ যদি লাগতো আমি কি বলতে পারতাম আমি আজকে কোর্টে যাব?’
আইনজীবী কাজল বলেন, ‘মাই লর্ড এটাও একটা গ্রেট রিলিজ যে আপনারা আপিল বিভাগ সপ্তাহে পাচঁ দিনই খোলা রেখেছেন। আমাদের দাবি হলো হাইকোর্টেরও কিছু কিছু বেঞ্চ ভার্চুয়ালি খুলে দেন।’
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি একা সিদ্ধান্ত নিই না। আমরা ছয়জন বসে সিদ্ধান্ত নিই। নিম্ন আদালত থেকে আমরা ভিডিও নিয়ে এসেছি। সেখানে লোকসমাগম আমরা দেখেছি। হাইকোর্টেরও অবস্থা ভালো না। ফিজিক্যাল কোর্টে শত শত লোক।’
কাজল বলেন, ‘মাই লর্ড গত এক বছরে আমরা কিন্তু ভার্চুয়ালি রপ্ত হয়েছি। গত বছরের শুরুর স্টগ্যাল এখন আর করতে হয় না।’
এ সময় আপিলের আরেক বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘মিস্টার কাজল, আপনিতো পরিস্থিতিটা দেখছেন। একদিনে তিনজন আইনজীবী মারা গেছেন। এই যে পরিস্থিতি এখন থেকে নিষ্কৃতির পথটা তো আমাদের বের করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা যদি কোর্ট লিমিট না করতাম তাহলে প্রতিদিন কোর্ট থেকে প্রতিদিন ১ হাজার লোক সংক্রমণ হতো। আমরা কি চাই কোর্ট না চলুক?’
আইনজীবী কাজল বলেন, ‘গত বছর করোনার কারণে যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল তখন সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবীদের লোন (ঋণ) দিয়ে পাশের দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এবার কিন্তু হয়তো সে সুযোগটা পাবো না। এই কারণে আইনজীবীদের জন্য আরও কয়েকটি বেঞ্চ খোলা রাখার কথা বলছি মাই লর্ড।’
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা যে ভাবি না, তা নয়। আজকে যে কোর্ট বসেছে। এভাবে চালাত গেলেও ১০ থেকে ১২ জন স্টাফ কাজ করছেন। হাইকোর্টে যদি আরও বেঞ্চ খুলে দিই তাহলে কত লোক লাগবে। প্রত্যেকটা জীবনই তার কাছে মূল্যবান। সরকার ছুটি ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি জানতে চান, এ পর্যন্ত কতজন বারের সদস্য মারা গেছেন। আইনজীবী কাজল বলেন, গতকাল পর্যন্ত বারের ১৩৭ জন মারা গেছেন।
বিচারপতি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে জজ সাহেবদের কাচ দিয়ে ঘিরে দিয়েছি, কিন্তু আইনজীবীদের কী হবে, সেটাও আমরা চিন্তা করেছি। আপনিও সতর্ক থাকেন।’
এ সময় সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুই সপ্তাহ যদি আমরা নিজেদেরকে সংবরণ করি তাহলে এটা কাট ডাউন করা সম্ভব। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সাতদিনের কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। আমার মনে হয়, এটা গতবারের তুলনায় ব্যাপক। বাস্তবটা চিন্তা করা উচিত। এর থেকে বাড়ানো ঠিক হবে না। বরং, বন্ধ করে দেয়া উচিত। পরে আদালত তালিকায় থাকা পরের আইটেম আগামি কালের জন্যে রাখেন।’
আপিল বিভাগ মঙ্গলবার ৫৮টি মামলার শুনানি করেছে। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে চারটি বেঞ্চে ভার্চুয়ালি শুনানি হয়েছে।
এফএইচ/এএএইচ/এমএসএইচ