ক্ষতিপূরণের ২০ লাখ টাকা পাবে কে?

চার স্ত্রীর দাবি ওয়ারিশ ৭ জন, আরেক স্ত্রীর দাবি ৫

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:৫১ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৩
নিহত নুর ইসলামের স্ত্রী দাবিদার চারজন-ফাইল ছবি

রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহতের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি) ঢাকার সিএমএম আদালতের সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়েছে। নিহত নুর ইসলামের স্ত্রীদের সৃষ্ট জটিলতায় এই টাকা হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না পরিবারের অন্য সদস্যদের।

পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে দাখিল করা একটি ওয়ারিশনামায় একসঙ্গে চার স্ত্রী ও তিন সন্তানের কথা উল্লেখ আছে। অন্যদিকে আরেক স্ত্রীর দাখিল করা ওয়ারিশনামায় দুই স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাকি সদস্যদের রাখা হয়েছে। এই ওয়ারিশনামা অনুযায়ী উত্তরাধিকারী পাঁচজন। এই জটিলতার কারণে আদালত থেকে এখন পর্যন্ত কাউকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

আদালত ওয়ারিশদের বিষয়টি তদন্ত করে থানা পুলিশকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

২০২২ সালের ১৫ আগস্ট বিকেল সোয়া ৪টার দিকে উত্তরায় প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রী নিহত হন। ওই গাড়িতে থাকা নবদম্পতি গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায়। নিহতরা হলেন আইয়ুব আলী হোসেন রুবেল (৫৫), ফাহিমা আক্তার (৩৮), ঝর্না আক্তার (২৭), ঝর্না আক্তারের দুই শিশুসন্তান জান্নাতুল (৬) ও জাকারিয়া (৪)। এ ঘটনার রাতেই নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝর্না আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাবু বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হন-ফাইল ছবি

আরও পড়ুন: ক্ষতিপূরণ ব্যয় ধরা আছে ২০ কোটি

মামলার পর হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন, হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু, ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেডের মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ ও মো. মঞ্জুরুল ইসলাম, ক্রেনচালক মো. আল-আমিন হোসেন ওরফে হৃদয়, রাকিব হোসেন, মো. আফরোজ ও ট্রাফিকম্যান মো. রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। বর্তমানে দশ আসামিই জামিনে। মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছে নিহতের পরিবার।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৫০ লাখ টাকা জিম্মানামায় বক্স গার্ডার ও ট্রেইলরফেরত পেয়েছে চায়না কোম্পানি

২০২২ সালের ১২ অক্টোবর দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দের জন্য আবেদন করে পুলিশ। আদালত ৩১ অক্টোবর চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের (সিজিজিসি) কর্মকর্তা রাসেল মিয়া ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ঘটনার জব্দ করা বক্স গার্ডার ও ২২ চাকা বিশিষ্ট একটি নম্বরবিহীন নীল রঙের ট্রেইলর জিম্মা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিম ২০ লাখ টাকা নগদ জমাদানের শর্তে ৫০ লাখ টাকা বন্ডে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানিকে জিম্মায় নেওয়ার আদেশ দেন।

পরে কোম্পানিটি ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ লাখ টাকা আদালতের সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেন। এছাড়া ৫০ লাখ টাকা বন্ডে বক্স গার্ডার ও ট্রেইলর ফেরত পান। তবে আদালত যখনই চাইবে চায়না কোম্পানিকে বন্ডে বক্স গার্ডার ও ট্রেইলর ফেরত দিতে হবে বলে আদেশে উল্লেখ করেন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: ৭০ টনের গার্ডার তুলছিল ৫০ টনের ক্রেন, ছিল না ফিটনেস

নিহতের পরিবারের সাত সদস্যের অনাপত্তিপত্র

২০২২ সালের ১৬ আগস্ট বিমানবন্দর টু গাজীপুর প্রজেক্টের কাজ চলাকালে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন এলাকায় অপ্রত্যাশিত একটি দুর্ঘটনা ঘটে। রেজাউল মণ্ডলের বাবা নূর ইসলাম ওরফে রুবেল হোসেন, রেহানার স্বামী নূর ইসলাম ওরফে রুবেল হোসেন, ফাহাদের মা ফাহিমা বেগম, রিয়া মনির মা ফাহিমা বেগম, জাহিদের স্ত্রী ঝর্না আক্তার, রাশিদুলের মেয়ে ঝর্না আক্তার ও আকলিমা বেগমের মেয়ে ঝর্না আক্তার, নাতনি জান্নাতুল ও নাতি জাকারিয়া মারা যান। ফলে উত্তরা পশ্চিম থানায় দণ্ডবিধি ৩০৪ (ক)/৩৩৮ ধারায় একটি মামলা করা হয়। ওই ঘটনার জন্য আমরা সবাই দুঃখিত এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আদালতের বাইরে আমাদের সঙ্গে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ লিমিটেড (সিজিজিসি) উভয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় একটি সমঝোতা হয়েছে। মামলার প্রজেক্টের কাজে ব্যবহৃত চায়না গ্যাঝুয়া গ্রুপ কোম্পানির (সিজিজিসি) একটি বক্স গার্ডার ও একটি ব্লু রঙের ট্রেইলর জব্দ করা হয়। জব্দ করা বক্স ও ব্লু রঙের ট্রেইলরটি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের (সিজিজিসি) বরাবর হস্তান্তর করলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

বিজ্ঞাপন

দুর্ঘটনায় বেঁচে যায় নববিবাহিত এই দম্পতি-ফাইল ছবি

আরও পড়ুন: গার্ডার সরানোর সময়ও সড়ক বন্ধ করেনি কেউ

সাতজনের নামে ওয়ারিশনামা, তদন্তের নির্দেশ আদালতের

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর মেহেরপুরের ৭নং বারাদী ইউনিয়ন পরিষদের আইয়ুব হোসেন রুবেল ওরফে নুর ইসলামের সাতজন ওয়ারিশ আছে বলে ওয়ারিশ সনদপত্র দাখিল করেন। ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) ওয়ারিশ সদস্যপত্রটি যাচাইয়ের জন্য নির্দেশ দেন। আগামী ২৪ জানুয়ারি এ বিষয় শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এই ওয়ারিশনামা দাখিল করেন নিহতের স্ত্রী মাহমুদা পারভীন ও রেহেনা। ওয়ারিশনামায় বাকি পাঁচজন হলেন-নুর ইসলামের স্ত্রী বিউটি বেগম, শাহিদা খানম, নুর ইসলামের দুই মেয়ে নিপা আক্তার ও সানজিদা খানম এবং তার ছেলে রেজাউল মণ্ডল।

আরও পড়ুন: বেঁচে রইলেন শুধু নবদম্পতি

এ বিষয়ে মামলার বাদী আফরান মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার সিএমএম আমাদের পরিবারের জন্য চায়না কোম্পানির কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে দিয়েছেন। ওয়ারিশনামা নিয়ে একটু সমস্যা রয়েছে। আদালত ওয়ারিশনামা তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।

বিজ্ঞাপন

এক ওয়ারিশনামায় চার স্ত্রী ও তিন সন্তানের তথ্য-ছবি জাগো নিউজ

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ ইয়াসিন গাজী জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহতের ঘটনায় করা মামলাটি তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। নিহতদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। রিপোর্ট হাতে পেলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবো।

আরও পড়ুন: প্রাইভেটকারে গার্ডার: ক্রেনচালকসহ গ্রেফতার ৯

তিনি আরও বলেন, চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি) নিহতের পরিবারকে স্বেচ্ছায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছে। ফলে তদন্ত বা মামলার বিচারের কোনো ক্ষতি হবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহতের ঘটনায় করা মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি) কোম্পানি নিহতের পরিবারকে স্বেচ্ছায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা আদালতের সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছে। এটা ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিমের উদ্যোগের কারণে সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের মামলায় এমনই হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: রুবেলের মরদেহ নিতে মর্গে স্ত্রী দাবিদার ৪ নারী

তিনি আরও বলেন, মামলার বিচারের ক্ষেত্রে এ ক্ষতিপূরণের সম্পর্ক নেই। স্বাভাবিক গতিতেই বিচার চলবে। আর্থিক ক্ষতিপূরণ এটাও এক ধরনের শাস্তি।

এই মামলায় আটক আসামিরা বর্তমানে জামিনে -ছবি জাগো নিউজ

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

বাদী পক্ষের আইনজীবী শাহাজাহান হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহতের ঘটনায় করা মামলায় আদালতের নির্দেশে চায়না কোম্পানি ২০ লাখ টাকা দিয়েছে। ওয়ারিশনামার জটিলতায় টাকা আটকে আছে। নিহত নুর ইসলামের স্ত্রী পরিচয়ে শাহেদা সাতজনের নাম উল্লেখ করে ওয়ারিশনামা দাখিল করেন। এছাড়া আমরা পাঁচজনের জন্য টাকা নেওয়ার আবেদন করেছি। আদালত শাহেদার ওয়ারিশনামাটি তদন্ত করে পুলিশকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ২৪ জানুয়ারি এ বিষয় শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আশা করছি সেদিনই এ বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।

জেএ/এসএইচএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।