মাল্টা থেকে গৃহিণীকে সোনার চেইন-আইফোন পাঠানোর নামে প্রতারণা

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪২ পিএম, ১১ জুলাই ২০২৪

ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা এসএম শাহরিয়ার আমিন (৩২)। ব্যবসা করেন গার্মেন্টস এক্সেসরিজের। তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে হঠাৎ অপরিচিত আইডি থেকে ক্ষুদেবার্তা আসে। স্ত্রী একজন গৃহিণী। সেই ক্ষুদেবার্তায় ওই ব্যক্তি নিজেকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয় দেন। পরবর্তীসময়ে তাদের মধ্যে কথা ও সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এরই একপর্যায়ে নিজেকে মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি মূল্যবান উপহারস্বরূপ সোনার চেইন, ঘড়ি, ডলার, কাপড়, ল্যাপটপ ও আইফোন দেওয়ার প্রস্তাব করলে তাতে রাজি হয়ে যান ভুক্তভোগী গৃহিণী। সেখান থেকেই প্রতারণার সূত্রপাত। বিষয়টি বুঝতে পারার পর ভুক্তভোগী গৃহিণীর স্বামী শাহরিয়ার আমিন বাদী হয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন।

এর আগে মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির প্রস্তাবে বাদীর স্ত্রী রাজি হলে আসামিরা পার্সেলের একটি ছবি দিয়ে জানান, তিনদিন পর সেই পার্সেলটি ঢাকা কাস্টমসে পৌঁছাবে। এরপর চক্রের অন্য সদস্য কাস্টমস এজেন্ট পরিচয়ে কাস্টমস চার্জ বাবদ ভুক্তভোগী নারীকে এক লাখ ৫৯ হাজার জমা দিতে বলেন।

অপরিচিত ফেসবুক আইডি থেকে মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয়ে বাদীর স্ত্রীর সঙ্গে সখ্যতা গড়েন প্রতারক চক্র। এক পর্যায়ে বন্ধুত্বের উপহারস্বরূপ বাদীর স্ত্রীকে সোনার চেইন, ডলার, কাপড়, ল্যাপটপ ও আইফোন পাঠানোর প্রস্তাব করেন প্রতারকরা

তার কথায় বিশ্বাস করে ওই নারী নিজের জমানো টাকা থেকে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেন। তবে একসময় তার ভুল ভাঙে। বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পুরো বিষয়টি স্বামীকে খুলে বলেন। এরপর তারা আইনের আশ্রয় নেন। এরই ধারাবাহিকতায় শাহরিয়ার আমিন ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

আরও পড়ুন

মামলার পর থানা পুলিশ তদন্তে নামেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল গ্রামের হুমায়ুন আহমেদের ছেলে রাজু আহমেদ (৩৪), আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের অ্যারোন ইনো (৪২), আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার ইনডিউরেন্স (২৮), বরগুনার তালতলী থানার হাড়িপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম খন্দকারের স্ত্রী মিতা ইসলামকে (৪৯) গ্রেফতার করা হয়।

ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪(২)/৩০(২)/৩৫ ধারায় চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক শেখ নূরুল ইসলাম। চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিরা একে অন্যের সহযোগিতায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয়ে বাদীর স্ত্রীসহ অন্য লোকদের মূল্যবান পার্সেল দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ করেছেন।

ভিসা ও পাসপোর্ট দেখাতে পারেননি দুই বিদেশি

চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলার পর অ্যারোন ইনোকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তিনি বাংলাদেশে অবস্থানের কোনো বৈধ কাগজপত্র, ভিসা ও পাসপোর্ট দেখাতে পারেননি। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ভাটারা থাকায় আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে অ্যারোন ইনো প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।

ভুক্তভোগী নারী নিজের জমানো টাকা থেকে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেন। তবে একসময় তার ভুল ভাঙে। বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পুরো বিষয়টি স্বামীকে খুলে বলেন। এরপর তারা আইনের আশ্রয় নেন

পরে তার দেওয়া তথ্য ও মোবাইল ফোন নম্বরের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে, প্রতারকদের সবার অবস্থান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কাছাকাছি। এরপর অভিযান চালিয়ে অন্য বিদেশি ইনডিউরেন্স ও বাংলাদেশি মিতা ইসলামকে ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। ইনডিউরেন্সও বাংলাদেশে অবস্থানের কোনো বৈধ কাগজপত্র, পাসপোর্ট ও ভিসা দেখাতে পারেননি। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধেও ভাটারা থানায় মামলা করা হয়।

প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতো চক্রটি

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, অপরাধকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে মিতা ইসলামকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে দেশের বিভিন্ন মানুষের কাছে থেকে প্রতারণা মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। বাদীর এজাহার সূত্রে ডাচ বাংলা ব্যাংক হিসাবের গ্রাহক রাজু আহমেদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রিমান্ডে রাজু তার ব্যাংক হিসাবের কথা স্বীকার করেন। এ অ্যাকাউন্টের টাকা প্রতারকচক্রের সবাই ভাগ ভাটোয়ারা করে নিতেন।

অবশিষ্ট টাকার চাপ দিলে প্রতারণা বুঝতে পারেন ভুক্তভোগী

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৫ মার্চ একটি অপরিচিত ফেসবুক আইডি থেকে মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয়ে বাদীর স্ত্রীর সঙ্গে সখ্যতা গড়েন প্রতারক চক্র। এক পর্যায়ে বন্ধুত্বের উপহারস্বরূপ বাদীর স্ত্রীকে সোনার চেইন, ডলার, কাপড়, ল্যাপটপ ও আইফোন পাঠানোর প্রস্তাব করেন প্রতারকরা। প্রস্তাবে রাজি হলে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল একটা পার্সেল ঢাকার কাস্টমস অফিসে পৌঁছানোর কথা জানানো হয়।

আরও পড়ুন

এরপর একজন ভুয়া কাস্টমস এজেন্ট বাদীর স্ত্রীর কাছে কাস্টমস চার্জ বাবদ এক লাখ ৫৯ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা পাঠাতে একটি ব্যাংক হিসাবও দেন প্রতারকরা। সরল মনে বাদীর স্ত্রী ওই হিসাব নম্বরে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেন। এরপর বাকি টাকা দিতে প্রতারকরা বিভিন্ন নম্বর থেকে চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে স্বামীর কাছে সব খুলে বলেন ভুক্তভোগী নারী। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলা দায়ের হয়।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক শেখ নূরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মাল্টার সংসদের চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে নিরীহ মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা সেই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করেছি। গ্রেফতার চার আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি।

আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম মজিদ (মানিক) জাগো নিউজকে বলেন, আসামি মিতা ইসলাম আমার কাছে আইনগত সহযোগিতার জন্য এসেছিলেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন।

এদিকে, মামলার বাদী এসএম শাহরিয়ার আমিন জাগো নিউজকে বলেছেন, আসামিরা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে পার্সেল দেওয়ার কথা বলে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পার্সেল না পেয়ে আমার স্ত্রী পুরো ঘটনাটি আমার সঙ্গে শেয়ার করে। আমি তাকে প্রথমে কিছুটা বকাঝকা করলেও পরে বুঝিয়ে বলি যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের বোকামি যেন আর না করে। এরপর প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করি। আমি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।

জেএ/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।