ওসমান হাদি কবিতা লিখতেন ‘সীমান্ত শরিফ’ নামে
সীমান্ত শরিফ ওরফে শরিফ ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠির নলছিটিতে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি ইনসাফ, সংগ্রাম ও মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। এই সংগঠনের মুখপাত্র ছিলেন তিনি। কবিতা লিখতেন নিপীড়িত মানুষের জন্য। বইও প্রকাশিত হয়েছিল একটি। যার নাম ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’।
একটা মানুষ কতটা শক্তিমান হতে পারে! তা লেখক দীপ্র হাসানের আলাপেই ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ: শিল্পের বারান্দায় ঠাস ঠাস বারুদের আভাস। এ কবিতা জীবনের। এ কবিতা যৌবনের। এ কবিতা ইনসাফের। রক্ত মাতাল সভ্যতার দিকে ছুঁড়ে দেয়া মলোটভ ককটেল এই কবিতা।’
বইটিতে পরাধীন বাংলার হৃদয়ের কথাগুলো ফুটে উঠেছে। ফেলানীদের কান্না খুব সুন্দর ভাষায় তুলে ধরেছেন কবি। কবিতার ভাষায় বলতে গেলে, ‘এক চোখে রাত দেখি, অন্য চোখে দিন লোপাটের উল্লাস দেখি এক চোখে অন্যটাতে মাথাপিছু ঋণ।/ এবার জোড়া চোখে বাজার দেখি—কয়েদির মতো কেঁদে পালায় অক্ষম পিতা।/ হঠাৎ মানচিত্র দেখি, দেখি—অক্ষ রেখায় রক্ত বেচার বিজ্ঞাপন আর শ্যাওলা রঙের শাড়ি পরে দ্রাঘিমায় খদ্দেরের জন্য দাঁড়িয়ে— একজন যুগপৎ বেশ্যা আর জননী।’
কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে বেশ ইতিহাস মিশ্রিত মনে হবে। কারো কারো মতে, এটি ইতিহাস মিশ্রিত অতীতের আলাপ নিয়ে বিদ্রোহী ও বজ্র কালির ফোঁটামাখা কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থের ৩২টি কবিতার শিরোনাম হলো—‘আগুন কি আলো নয়’, ‘আমায় ছিঁড়ে খাও...’, ‘বেওয়ারিশ সন্ধ্যা’, ‘অবহেলার আভিজাত্য’, ‘মায় মরণের ছবি আঁকে’, ‘মায়ার অ্যাস্ট্রোনমি’, ‘আমায় ক্ষমা করো...’, ‘বোবার চক্ষু’, ‘সুরকির সংসার’, ‘আকসার কয়লা’, ‘কালো পাথরে কাবার...’, ‘সার্বভৌমত্ব’, ‘মায়াকীর্ণ’, ‘পাপের কাছে প্রার্থনা’, ‘বধির দুপুর’, ‘তবুও শূন্যতায় পাতি ঘর’, ‘দরদ রাতে বারুদ আলাপ’, ‘মাগরেব’, ‘বোবার আবার বর্ণমালা’, ‘আব্বান’, ‘জ্যান্ত কফিন’, ‘পেরির প্রলেপ’, ‘বোর্ডিং’, ‘না-করা সংসার’, ‘প্রেমোগ্রাফি’, ‘অন্তরঙ্গ অবহেলা’, ‘সীমান্তের নীল শিমুল’, ‘পাংশুল প্ল্যাকার্ড’, ‘না পোষা, না সর্বনাশা’, ‘অঙ্গার’, ‘পালকি’ এবং ‘কাঠ বলে করাত হবো’।
লেখক আসিফ মাহামুদ বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘তার কাব্যগ্রন্থের কবিতামালায় আলাপ তুলেছেন, মুসলিমদের ঈমানের অংশ আল কুদস নিয়ে, বিবরণ দিয়েছেন নির্যাতনের, দ্রোহ তুলেছেন পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইয়াহুদীদের প্রতি। আলাপ তুলেছেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। এই বয়সে এসে কবির বেশ করে মনে পড়লো ছাত্রাবাসের দিনগুলির কথা। একটি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন–মৃত্যুর পরে তার মায়ের আবদার, বাবাকে নিয়ে আলাপ তুলেছেন অন্য একটি কবিতায়। তার কাব্যগ্রন্থে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসাও স্থান পেয়েছে ভীষণভাবে।’
‘আমায় ছিঁড়ে খাও হে শকুন’ কবিতায় কবি তাকে হত্যা করার আকুতি জানিয়েছেন। ফুটিয়ে তুলেছেন মুদ্রাস্ফীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতি। তিনি বলেছেন, দোজখের ভয়ে তিনি আত্মহত্যা করতে চান না। তাই এই রাষ্ট্র নামক জাহান্নামে তাকে হত্যা করা হোক।
আরও পড়ুন
হুমায়ূন আহমেদ: সময়ের প্রতিচ্ছবি
জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ
‘মায় মরণের ছবি আঁকে’ কবিতায় তার মায়ের সঙ্গে আলাপ করছেন। মৃত্যুর পরে কবি যেন মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সুরা পাঠ করেন। তবে কবির আকুতি হলো, আলিফের মতো মায়ের শরীরটা বাঁকা হয়ে গেলেও মা যেন আর ক’টা দিন বেঁচে থাকেন। মাটির চুলায় রান্না করেন। মৃত্যু হলে যেন দু’জনের একসঙ্গেই হয়। তাই তো এ কবিতায় মায়ের প্রতি নিদারুণ ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।
‘আকসার কয়লা’ কবিতায় গাজার বিমর্ষ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন—‘মায়েরা বাচ্চাদের পায়ে নাম লিখে রাখছে। যেন লাশ হওয়ার পরে চিনতে পারে’। কবি এই কবিতায় বাইতুল মাকদিসের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন। কবির ভাষায়, ‘আল্লা গো, আদি কেবলা আকসার দোহাই/ গাজার শিশুদের দিকে একটু তাকাও—/ আরশ থেকে ওদের ছেঁড়া কলিজা কি দেখা যায় না?’
‘সার্বভৌমত্ব’ শিরোনামের কয়েক লাইনের কবিতাটি খুব উপলব্ধির। তিনি মায়ের সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্বকে তুলনা করেছেন। তিনি যেমন সব সময় মায়ের আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকতে চান; তেমনই সব সময় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হোক—এটাই কামনা করেছেন। এই কবিতায় নাগরিকদের অধিকারের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
‘বোডিং’ কবিতায় পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছাড়ার স্মৃতি তুলে ধরেছেন। চৈত্র মাসে রোদের মধ্যে বাবা আসবাবপত্র মাথায় নিয়ে রওয়ানা হয়েছেন ছাত্রাবাসের দিকে। কবি পাঠশালায় হাজির হওয়ার পর পুরোনা শিক্ষার্থীরা ভয় দেখাচ্ছিলেন। কবি আরও বলেছেন, ‘অসুখ হলে ছুটি নাই। কাঁদলে নাম কাটা।’
‘প্রেমোগ্রাফি’ কবিতায় প্রেম বলতে বুঝিয়েছেন, শত লাবণ্যে হৃদয়ে চিড় ধরার প্রত্যাবর্তনের মতো। কবি অর্ধাঙ্গিনীর শূন্য ডিসটেন্সকে প্রেম বলেছেন। তিনি মনে করেন প্রেমের কোনো বিছানা হয় না। প্রেম বলতে বোঝেন একটি প্রতিরোধের আঙিনা। অবৈধ প্রেমকে সাহারা মরুভূমি ও পাপের প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সবমিলিয়ে ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ কাব্যগ্রন্থটি এই সময়ের কাব্যগ্রন্থ। যে গ্রন্থে সমাজ সংস্কৃতি দেশীয় ও বিশ্বরাজনীতির আলাপ তুলে প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে মাখিয়ে দিয়েছেন ওসমান হাদি বা সীমান্ত শরিফ। বইটি প্রকাশ করেছে দুয়ার প্রকাশনী। ৪৮ পৃষ্ঠার বইটি ২০২৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা।
এসইউ