বিসিএস ক্যাডার হয়েও প্রফেশনাল জেলাসির শিকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রনি!

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৫ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুবুর রহমান রনি/ ছবি- জাগো নিউজ

জন্ম থেকেই অন্ধ। কিন্তু সেই অন্ধত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অন্ধত্বকে পেছনে ঠেলে শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। হয়েছেন বিসিএস ক্যাডার। দেশের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিসিএস ক্যাডার মাহবুবুর রহমান রনির অনবদ্য সাফল্যের জন্য তার বাবা হাকীম মো. ছাদুল্লাহ বাচ্চু শ্রেষ্ঠ পিতা হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। এই সম্মাননা পেয়ে বাবা-ছেলে দুজনই আপ্লুত।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিসিএস ক্যাডার মাহবুবুর রহমান রনির ভাষ্য, বাবা-মায়ের জন্যই তার এই অর্জন। তিনি এখন প্রতিবন্ধী নন, বরং বাবা-মা হারিয়ে গেলে তিনি সত্যিকার অর্থেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়বেন। রনি বলেন, আমার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। আমি সারাজীবন সংগ্রাম করে যাবো।

বুধবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিসিএস ক্যাডার মাহবুবুর রহমান রনির বাবার হাতে পুরস্কার তুলে দেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। পরে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপাকালে রনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে রনির বাবা ছাড়াও আরও সফল ২০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তাদের সবাইকে সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট ও নগদ ১০ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়। ৩৪তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২৭তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস- ২০২৫ উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি’। একই সঙ্গে দিবসটি উপলক্ষে একই স্থানে তিন দিনব্যাপী প্রতিবন্ধী উন্নয়ন মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ বুধবার শুরু হওয়া এ মেলা চলবে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বার্থ সুরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের ৩২টি স্টল মেলায় অংশ নিয়েছে।

jagonews24

অনুষ্ঠানের পরে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় রনি ও রনির বাবার। তাদের বক্তব্যে প্রাপ্তি, অর্জন ও চ্যালেঞ্জের কথাও উঠে আসে। জন্মান্ধ মাহবুবুর রহমান রনি বলেন, এখন আমার নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে হয় না। আমি সেদিন প্রতিবন্ধী হয়ে যাবো, যেদিন বাবা ও মা আমার পাশে থাকবে না। কারণ আমি আজ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, তারপরও দেখি এই যে প্রফেশনাল জেলাসি! এই আমি এই পর্যন্ত চলে এসেছি, যারা চোখে দেখতে পায় তাদের অনেকে বাহাবা দেয়, আন্তরিকতার সঙ্গে নেয়। যদিও প্রফেশনাল জায়গায় কেউ আমাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। আমার নিজের কাজ আমার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে হয়।

তিনি বলেন, রনি কোনটা পারে না, সেটা সবার মুখস্থ। তবে রনি কোনটা করতে পারবে এখন পর্যন্ত সেটি কারও জানা নেই। আমার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। সারাজীবন সংগ্রাম করে যাবো। আমি সংগ্রাম করে যখন বাসায় ফিরি, সংগ্রাম করার জন্য যখন মাঠে নামি- আমার পিতামাতা যতদিন পাশে আছেন ততদিন আমাকে একলা মনে হবে না।

রনির বাবা হাকীম মো. ছাদুল্লাহ বাচ্চু বলেন, রনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থায় এমফিল করেছে। বর্তমানে সিলেটের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক।

আরও পড়ুন
প্রতিবন্ধীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে: সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা 
‘শুধু ভাতা নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবন্ধীদের সহায়তা দিতে হবে’ 

তিনি বলেন, অনেক বছর পর সম্মাননা পেলাম। রনির এই অর্জন সরকারি পর্যায়ে আমাকে সম্মানিত করলো। এই অনভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। এই আনন্দের সীমা নেই। যে জায়গায় আজ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, সেটি রনির প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রনির মতো অন্য প্রতিবন্ধীরাও সব প্রতিবন্ধকা জয় করে সমাজের সবোর্চ্চ সাফল্য অর্জন করুক, এটিই আমরা প্রত্যাশা।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে দৃষ্টিহীন বিসিএস ক্যাডার মাহবুবুর রহমান রনি বলেন, আমি স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। দেশের বাইরে থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছি। বর্তমানে অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ করছি। আমার বাবা-মা আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। আমার ভাই-বন্ধু যারা চাকরির দাবি করছেন, আপনারও যদি এভাবে নিজেকে গড়ে তোলেন তবে আপনারও আমার মতো দেশের সেবা করে যেতে পারবেন।

রনির দেশের বাড়ি সিলেটের বাহুবল উপজেলার খাদিমনগরে। তার মা রাবেয়া খানম রুবি। রনির ৩ বোন রয়েছে। পরিবারে সবার বড় তিনি। ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পান তিনি।

অনুষ্ঠানে সমাজল্যাণ উপদেষ্টা তার বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সমস্যা ও মতামত জানতে চান। বিভিন্ন দাবি আদায়ে প্রতিশ্রুতিও দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ। আরও বক্তব্য দেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইদুর রহমান খান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন।

ইএইচটি/কেএসআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।