টিফা বৈঠকের আগে আরসেপে যোগদানে বাংলাদেশকে সমর্থন অস্ট্রেলিয়ার
চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট আরসেপ-এ (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ) যোগ দেওয়ার দীর্ঘদিনের আগ্রহ বাংলাদেশের। অবশেষে সেই পথে বড় সমর্থন দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সম্প্রতি বাংলাদেশের সদস্যপদ চাওয়ার বিষয়ে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ঢাকায় বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কাঠামোর (টিফা) বৈঠকে বসছে। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে আরসেপ।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে থাকবেন দেশটির পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য সংক্রান্ত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক প্রথম সহকারী সচিব সারাহ স্টোরি।
বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দুই দেশের বৈঠকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, টেক্সটাইল, উল-কটন, জুট, লেদার, খনিজ সম্পদ, কৃষি, শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা, এলএনজি সরবরাহ থেকে শুরু করে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সবই আলোচনায় আসবে। তবে সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হবে বাংলাদেশের আরসেপে যোগদানের বিষয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, অস্ট্রেলিয়া বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি হওয়া ‘বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যান’ নিয়ে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা সংকট- এই চারটি খাতকে ভিত্তি করে অস্ট্রেলিয়া আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে চায়। পাশাপাশি উল সেক্টর নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করতে আগ্রহী তারা।
তিনি বলেন, এবারের টিফা বৈঠকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে আরসেপ। বাংলাদেশ অনেকদিন ধরে জোটটিতে যোগ দিতে চেষ্টা করছে। অস্ট্রেলিয়া গত নভেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে- বাংলাদেশকে তারা সমর্থন দেবে। এটা আমাদের জন্য বড় সুযোগ।
সরকারের আরেক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ এখন কার্যকর কোনো বাণিজ্য ব্লকের সদস্য নয়। সাফটা কার্যকর হয়নি, বিমসটেকও কাঙ্ক্ষিতভাবে কাজ করছে না। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল আরসেপে যোগ দিতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে।
২০১১ সালে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে আরসেপের নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়। ভারতও শুরুতে সদস্য ছিল। তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে মোদি সরকার জোট থেকে সরে দাঁড়ায়।
সরকারি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই আরসেপে যোগদানের আলোচনা শুরু হয়। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আবেদন করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চাইলে ভারতের আপত্তির মুখে শেখ হাসিনা ফাইলে সই করেননি।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পথে। উত্তরণের পরও অস্ট্রেলিয়া ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেবে কি না- এ নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হবে।
সরকারের আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তবে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে অনিশ্চয়তা আছে। তবুও সার্বিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান আশাব্যঞ্জক বলেই মনে করছে ঢাকা।
আরসেপ বা রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য চুক্তি। আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশসহ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড- মোট ১৫টি দেশ নিয়ে গঠিত এই জোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ২০১১ সালে আলোচনার সূচনা এবং ২০২০ সালে চুক্তি সইয়ের পর আরসেপ কার্যকর হলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুল্ক-কোটাসহ বাণিজ্য বাধা কমিয়ে রপ্তানি, আমদানি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দ্রুত বিস্তৃত বাজার, বড় ভোক্তা শ্রেণি এবং বৈচিত্র্যময় সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে।
বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই এই আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্লকে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ২০১৯ সালে ভারত আলোচনার টেবিল থেকে সরে গেলেও বাংলাদেশ আগ্রহ ধরে রাখে। তবে তৎকালীন সরকারের সময়ে ভারতের আপত্তির কারণে সদস্যপদের আবেদন চূড়ান্ত হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ আবারও সক্রিয়ভাবে আরসেপে যুক্ত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে সদস্যপদের আবেদন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে এবং জোটের দেশগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে।
সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরসেপে যোগ দিতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের সংযোগ জোরদার হবে, তৈরি পোশাকসহ উৎপাদনমুখী খাতে নতুন বিনিয়োগ আসতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় আরও প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে পারে এই জোটে যোগদান।
জেপিআই/এএমএ