শতকোটির বিশ্রামাগার এখন বখাটেদের কবজায়
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লায় নির্মিত আধুনিক পার্কিং সুবিধাসম্পন্ন গাড়িচালকদের বিশ্রামাগারটি নির্মাণের এক বছর পার হলেও এখনো চালু হয়নি। প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্থাপনা বর্তমানে বখাটে ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। পণ্যবাহী যানবাহনের চালকদের দাবি, জাতীয় মহাসড়কে নিরাপত্তার ঝুঁকি কমাতে দ্রুত বিশ্রামাগারটি খুলে দেওয়া হোক।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ক্লান্ত চালকদের বিশ্রামের সুযোগ দিতে ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট সড়ক ও জনপদ বিভাগ দেশের ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও মাগুরা জেলায় পণ্যবাহী গাড়ি চালকদের জন্য চারটি বিশ্রামাগার নির্মাণের প্রকল্প একনেক সভায় পাশ হয়। ওই অর্থ বছরেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার এলাকায় ১৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে ১০০ চালকের জন্য আধুনিক একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। আধুনিক চারতলা বিশিষ্ট এই বিশ্রামাগারটির প্রাথমিক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৬৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন ও দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এতে ব্যয় হয় ৯৬ কোটি টাকা।
আধুনিক এই বিশ্রামাগারটি ঘিরে রয়েছে গোসলখানা, নামাজের স্থান, বিশ্রাম কক্ষ, ক্যান্টিন, বিনোদনের সুযোগ ও ট্রাক পার্কিং। এছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন মেরামতের জন্য রয়েছে ওয়ার্কশপও। পণ্যবাহীগাড়ির চালকরা অল্প খরচে এসব এইসব সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
তবে নির্মাণের দীর্ঘ এক বছর সময় অতিবাহিত হলেও এখনো ইজারা দেওয়া কিংবা সরকারি তত্ত্বাবধানে উদ্বোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বিশ্রামাগারটির। নির্মিত এই স্থাপনাটির নিরাপত্তা প্রহরী বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র দুই জন ব্যক্তি থাকায় বিশ্রামাগার এলাকাটি এখন বখাটে ও অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে দিনের বেলায় চলে উচ্চস্বরে গান-বাজনা ও টিকটকের শুটিং, আর রাতে মাদকসেবী এবং দেহ ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়। এতে স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আলি উল্লাহ, সামছুল হক ও আনোয়ার বলেন, গত এক বছর ধরে বিশ্রামাগার এলাকাটি যেন রংমহলে পরিণত হয়েছে। দিনে গান-বাজনা ও ভিডিও শুটিং চলে, আর রাতে মাদকসেবী ও অপরাধীদের দখলে থাকে। এতে আমাদের এলাকার সুনামও নষ্ট হচ্ছে। দ্রুত সরকারি এই স্থাপনাটি উদ্বোধের দাবি জানান তারা।
ট্রাকচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় দীর্ঘ পথ চালানোর পর ক্লান্তি আসে, চোখে ঘুম ভর করে। মহাসড়কের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম নিতে গেলে চোর-ডাকাতের ভয় থাকে। সরকার যে বিশ্রামাগার নির্মাণ করেছে, সেটি চালু হলে চালকরা উপকৃত হতো।
আনোয়ার হোসেন নামে এক ট্রাক চালক বলেন, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় দীর্ঘ পথ চালানোর পর চালানোর পর চোখে ঘুম ভার করে। যখন মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিতে গেলে চোর-ডাকাতের ভয় থাকে। সরকার যে বিশ্রামাগারটা নির্মাণ করেছে, সেটি চালু করা হলে তারা উপকৃত হতেন।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের কুমিল্লা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক রোটারিয়ান কাজী জাকির হোসেন বলেন, বিশ্রামাগারটি চালু হলে মহাসড়কে পণ্যবাহী চালকদের ভ্রমণজনিত ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হবে। সেই সঙ্গে চালকরা স্বস্তিদায়কভাবে গাড়ি চালাতে পারবেন। ফলে মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমবে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কুমিল্লার সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের পাশে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিশ্রামাগারটারটির কাজ শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকা দুঃখজনক। শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে হবে না, এর সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ থাকবে দ্রুত চালকদের জন্য বিশ্রামাগারটি উন্মুক্ত করা হোক।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও কুমিল্লা জেলার সভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহারকারী পণ্যবাহী গাড়িচালকদের জন্য অধুনিক সুবিধাসহ বিশ্রামাগার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শতকোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এটি চালকদের কোনো কাজেই আসছে না। সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আইনি কোনো জটিলতা থাকলে দ্রুত শেষ করে চালকদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। এতে সড়কে দুর্ঘটনা ও চুরি ডাকাতি কিছুটা হলেও কমবে।
কুমিল্লা অঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের এসপি (অতিরিক্ত ডিআইজি) শাহিনুর আলম খান বলেন, রাতে ইউটার্ন এলাকায় অনেক চালক মহাসড়কের ওপরই গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নেন, এতে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। দ্রুত বিশ্রামাগারটি চালু করা হলে চালকরা নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম নিতে পারবেন। এতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহাণির ঘটনা কিছুটা হলেও কমবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হয়েছে। এখন এটি কোন পক্রিয়া অনুসরণ করে ইজারা কিংবা টেন্ডার দেওয়া হবে সেই অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছি। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনএইচআর/এমএস