প্রশ্নবিদ্ধ নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল কার্যালয়ের দুজন সার্ভেয়ার গত বছর প্রতিদিন গড়ে ৯টির বেশি নৌযানের ফিটনেস (সার্ভে) পরীক্ষা করেছেন। আর ঢাকা নদীবন্দরের (সদরঘাট) সার্ভেয়ার ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন গড়ে ৭টির বেশি জাহাজের। সংস্থার বার্ষিক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী ৬ হাজার ৯৩১টি নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল কার্যালয়ের আওতায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৯টি নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন সার্ভেয়ার মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার।
নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় থেকে ২ হাজার ২৭৫টি নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন সার্ভেয়ারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. এসএম নামজুল হক। আর ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) কার্যালয় থেকে এক হাজার ৮৩৮টি নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করেন মির্জা সাইফুর রহমান এবং মুঈনউদ্দিন জুলফিকার। গত বছর সরকারি কার্যদিবস ছিল ২৪৫ দিন। এ হিসাবে প্রতিদিন উপরোক্ত সংখ্যক নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন সার্ভেয়ারর।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সার্ভেয়ার নিজে জাহাজ পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক থাকলেই কেবল চলাচলের উপযোগী ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার বিধান রয়েছে। আনুষঙ্গিক কার্যক্রম এবং জাহাজ পরিদর্শন করে ফিটনেস পরীক্ষা করলে গড়ে ৫টির বেশি জাহাজ সার্ভে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক জাহাজের ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন তিনজন সার্ভেয়ার।
অভিযোগ রয়েছে, ফিটনেস পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই অফিসে বসে টাকার বিনিময়ে নৌযানের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছেন কয়েকজন সার্ভেয়ার। একই অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামে অবস্থিত সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের অধীনস্থ সংস্থা নৌবাণিজ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধেও। এ সংস্থাটি সমুদ্রগামী জাহাজের সার্ভে সনদ দিয়ে থাকে। জাহাজের ফিটনেসের ওপর যাত্রী ও নৌপথের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করে। যদিও অনিয়মের ওই অভিযোগ অস্বীকার করে সার্ভেয়াররা দাবি করেছেন, সরকারি ছুটির দিনে সার্ভে করেন তারা। সরকারি কর্মদিবসে সর্বোচ্চ পাঁচটি ও ছুটির দিনে ১০টি নৌযান সার্ভে করার অফিস আদেশ রয়েছে। ছুটির দিনেও নৌযান সার্ভে করেন কেউ কেউ।
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্রে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ রুটে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ৯ হাজার ৮৫২টি। এর মধ্যে যাত্রীবাহী ছোট-বড় নৌযানের (লঞ্চ) সংখ্যা ১ হাজার ১২২টি। বাকিগুলো পণ্যবাহী ও অন্যান্য নৌযান। গত বছর ৬ হাজার ৯৩১টি নৌযানের ফিটনেস (সার্ভে) পরীক্ষা করা হয়েছে। ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলাচল করছে ২ হাজার ৯২১টি নৌযান। ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়াই চলাচল করায় এসব জাহাজ থেকে বিপুল রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। সারা দেশে চলাচলকারী জাহাজের ফিটনেস পরীক্ষার জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের তিনজন সার্ভেয়ার রয়েছেন। এছাড়া দুজনকে সার্ভেয়ারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫ জন সার্ভেয়ার কাজ করছেন।
নৌযান ফিটনেস সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, সার্ভে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক আগ থেকেই অনিয়ম হয়ে আসছে। এসব বন্ধে আমি কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। পর্যাপ্ত সার্ভেয়ার না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়েছে, কঠোর অবস্থান থেকে পিছু হটতে হয়েছে। তিনি বলেন, জনবল সংকট থাকলে অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কারণে সার্ভেয়ারের পদ বাড়িয়ে সংস্থার নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরে ফিটনেস পরীক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে অভিযোগ করে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যা-প) সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ৭০ ফুট পর্যন্ত ছোট লঞ্চের সার্ভের জন্য ৫ হাজার টাকা, ১০০ ফুটের বেশি লঞ্চের জন্য ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং বড় লঞ্চ ও মালবাহী নৌযানের জন্য আরও বেশি টাকা সার্ভেয়ারদের দিতে হয়। তিনি বলেন, আইনে সার্ভেয়ারদের যুক্তিসঙ্গত খরচ দেয়ার বিধান থাকলেও তাদের বেশি টাকা না দিলে মালিকদের হয়রানি করেন। কারিকুলামের বাইরে কাগজপত্র চেয়ে ভোগান্তি সৃষ্টি করেন। কখনও কখনও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয়ায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার পরই প্রায় প্রতিটি তদন্তে সার্ভের অনিয়ম ধরা পড়েছে। পিনাক-৬, মিরাজ-৪, শাথিল-১ লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে। মাওয়া-কাওড়াকান্দি চলাচলকারী অর্ধশতাধিক নৌযানের রি-সার্ভে করে সব কটিতে ক্রটি পেয়েছেন খুলনার সার্ভেয়ার শাহরিয়ার হোসেন। তিনি ওই লঞ্চ খাল-বিল বা ছোট নদীতে কেবল চলার উপযোগী বলে সুপারিশ করেছেন। অথচ এসব লঞ্চকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অস্থায়ী (টোকেন) চলাচল অনুমতি দেয়ার নামে চলে বাণিজ্য। একটি নৌযান একবারে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন চলতে পারে। কিন্তু একই জাহাজকে ১১বার টোকেন দেয়ার নজির রয়েছে।
বারবার এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তবে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ অফিসের ফিটনেস পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সার্ভেয়াররা মালিক ও মাস্টারের পূরণ করে দেয়া একটি চেকলিস্ট অনুযায়ী নৌযানের অবস্থা ঠিক আছে কিনা- তা যাচাই করে ফিটনেস সনদ দিচ্ছেন। বাস্তবে ওই নৌযানের ভারসাম্য ঠিক আছে কিনা- তা যাচাই করেন না। পিনাক-৬ দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সার্ভে প্রক্রিয়া পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের আলোকে নতুন চেকলিস্ট তৈরি করা হয়, তবে তা এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সূত্র : যুগান্তর
এসএইচএ/আরআইপি