ভেলোরে মহাবিপদে বাংলাদেশিরা, যেকোনোভাবে দেশে ফেরার আকুতি

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২২ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২০

চিকিৎসার জন্য ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোরে গিয়ে আটকা পড়া শত শত বাংলাদেশি এখন দিশেহারা। করোনাভাইরাসের কারণে অনেকের চিকিৎসা বন্ধ। কারো কারো চিকিৎসা শেষ হলেও দেশে ফিরতে পারছেন না। ওষুধ ও খাবার সংগ্রহের মতো জরুরি কাজে রাস্তায় বের হলেই পুলিশ ছাড়াও স্থানীয়রা মারপিট করছে। ফোর্ট সিটি বা দুর্গের শহর হিসেবে পরিচিত জেলাটিতে আটকা পড়া বাংলাদেশিরা এখন মূলত বন্দি। সুস্থ হওয়ার জন্য গিয়ে এখন তারা শারীরিক ও মানসিক রোগী হয়ে পড়ছেন।

দক্ষিণ ভারতের শুষ্ক মাটি ও পাথরের পাহাড় ঘেরা শহরটির কাঠিন্য তাদের জীবনে ভর করেছে। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটলেও কারো কোনো আশ্বাস না পেয়ে দিশেহারা তারা। দুই দেশেরই অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি প্রায় বন্ধ থাকায় দেশ থেকে তারা টাকাও নিতে পারছেন না। কারো কারো দেশ থেকে টাকা নেয়ার সামর্থ্য নেই।

ভারত সরকার তাদের নাগরিকদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিলেও বাংলাদেশিদের দেখার কেউ নেই। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে তারা আবেদন করেছেন যেভাবেই হোক তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার। ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব না হলে সেখানেই যেন তাদের সাহায্য করা হয়। এটা শুধু ভেলোরে আটকে পড়া নয়, ভারতের অন্যান্য জায়গায় আটকা পড়াদেরও আকুতি। পরবাসে নয়, তারা দেশে এসেই মরতে চান বা না খেয়ে থাকতে চান।

সেখানে আটকা পড়া প্রায় ২০ জনের মতো রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। এর বেশির ভাগই যান ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে (সিএমসি) চিকিৎসা নিতে। ১১৮ বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের চিকিৎসার মান অত্যন্ত ভালো। খরচও তুলনামূলক কম। এজন্য বাংলাদেশ, নিজ দেশ ভারতের কলকাতা শহর ছাড়াও বিভিন্ন শহর, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার রোগী নিরাময়ের আশায় সেখানে যান। রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিয়েও স্বস্তিবোধ করেন। কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের ভিড় প্রচুর। সেখানে সিএমসি ছাড়াও নারায়ানা হৃদয়ালয়া হাসপাতালে যান অনেকে।

ভেলোরে আটকে পড়া রোগী আদিত্য কর্মকার জাগো নিউজকে বলেন, করোনাভাইরাসে যদি মরতেই হয় তাহলে নিজের দেশের মাটিতে মরতে চাই। নিজের মা-বাবা এবং পরিবারকে একবার দেখে মরতে চাই। চিকিৎসার সব কার্যক্রম শেষ করেও এখন আমি দেশে ফিরতে পারছি না। টাকা-পয়সা প্রায় শেষের দিকে। ভারত সম্পূর্ণভাবে লকডাউন থাকায় এখানে খাদ্যদ্রব্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও খাবার পাওয়া প্রায় মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমি নযা আমার মতো হাজার হাজার মানুষ এখানে বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিভিন্ন অফিসে ফোন দিয়েও কোনো বিশ্বাসযোগ্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আমাদের এখান থেকে দ্রুত উদ্ধার করার ব্যবস্থা করা হোক।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করা দিলসাদ কবিরও সেখানে আটকা পড়েছেন। তিনি বলেন, গত ১৭ মার্চ আমি আমার মাকে নিয়ে ভেলোরে আসি। মাকে সার্জারি করার কথা ছিল ২৩ মার্চ। কিন্তু সেদিনই একজন করোনা রোগী ধরা পড়ে। আমাদের ট্রিটমেন্ট মাঝপথেই থেমে গেছে। ডাক্তার মেডিসিন দিয়ে দিছেন। এখন আর ট্রিটমেন্ট হবে না। আমার মা আর আমি এ অবস্থায় কীভাবে থাকি! কলকাতাও যেন যেতে পারি, এমন একটা ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হোক।

সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া সাইফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি গত ৫ মার্চ মায়ের লিভার চিকিৎসার জন্য ভেলোরে আসি। ২৪ মার্চ মাকে রিলিজ দেয়া হয় । কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে সিএমসি পুরোপুরি চিকিৎসা করেনি। এরপর থেকে দেশে ফেরার আর কোনো ফ্লাইট পাচ্ছি না। এখন আমরা হোটেলে বন্দি। মাকে অর্ধেক ট্রিটমেন্ট করার জন্য দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সেখানে ভারতের সরকার তাদের নাগরিকদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশিদের দেখার কেউ নেই। আমাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে না পারলেও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।’

মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার ছোট বোন ফাতেমার (৩১) চিকিৎসার জন্য ভেলোরে এসেছিলাম। ছোট বোনের বাসকুলার সার্জারি করা হয়েছে। চিকিৎসার কাজ শেষ হয়েছে গত ২৩ মার্চ। সেই থেকে রোগী নিয়ে আটকা পড়ে আছি।’

ঢাকা কলেজের ছাত্র সাখাওয়াত হোসেন তার মায়ের চিকিৎসার জন্য ভেলোরে যান। তার মায়ের কিডনির সমস্যা। তিনি বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সিএমসিতে আসি। অনেক কষ্টে আছি। টাকা শেষ। আজ শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি। টাকা আনারও কোনো উপায় নেই। আমার মায়ের কিডনির সমস্যা। পুলিশের ভয়ে বাজার করতেও বের হতে পারি না। ভাড়ার টাকা দিতেও পারব না৷ দেশ থেকে টাকা আনার সব পথ শেষ। বাংলাদেশের হাইকমিশনের যে নম্বরটা শেয়ার করছে সেটাও বন্ধ। আমি কলকাতা হাইকমিশনে যোগাযোগ করছি৷ বলছে, কিছু করার নেই। তাদের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। এখন আমরা কী করবো?

মেহেরুন নেছা জিনিয়া বলেন, আমরা এখানে ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) করাতে এসেছি। করোনার কারণে সিএমসিতে আপাতত ট্রিটমেন্ট বন্ধ। আটকা পড়া অবস্থায় বাংলাদেশের হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরছি। তারা বাংলাদেশি নাগরিকদের সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এখনও কোনো উত্তর পাচ্ছি না। তারা আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করছেন না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রোববার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টেলিফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ভারতে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। আমরা শুনতে পাচ্ছি চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানে কিছু বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন এবং তাদের থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের দূতাবাস ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেছে। যারা এখনও জানাননি, আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা একসঙ্গে কতজন, কোথায় আছেন, নাম, বয়স, পাসপোর্ট নম্বর, যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর আমাদের দিল্লিতে অবস্থিত দূতাবাসে জানান। আমাদের দূতাবাসের টেলিফোন নম্বর ৮৫৯৫৫-৫২৪৯৪। যারা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন তাদের আবার জানানোর প্রয়োজন নেই।

তিনি আরও বলেন, পূর্ণ তালিকা পেলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে না আনতে পারা পর্যন্ত আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবো। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেন তাদের চাহিদার বিষয়গুলো দেখভাল করেন। আর যারা ফিরে আসতে চান তাদের সবাইকেই আশকোনা হজক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

এইচএস/এমএসএইচ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।