আঙুলের ছাপ

অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ শনাক্তে সফলতা ২২.৯৪ শতাংশ

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২২

চট্টগ্রামে আকবর শাহ থানার ফিরোজ শাহ কবরস্থানে পড়েছিল প্রায় ২০ বছর বয়সী এক তরুণীর মরদেহ। পাশেই কাপড়ভর্তি ব্যাগ, স্যান্ডেল। দেখে মনে হয় তাকে কিছুক্ষণ আগেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির ছবি আশপাশের কলোনিগুলোতে দেখানো হয়, ছাপানো হয় পোস্টার। তবে কোনোভাবেই তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। সম্ভব হয়নি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনও।

এরপর ওই নারীর পরিচয় পেতে হাতের আঙুলের ছাপ পাঠানো হয় নির্বাচন কমিশনে। কমিশন সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে ঘুরে সেই আবেদন নাকচ হয়। আইনে না থাকায় সেসময় মরদেহের পরিচয় শনাক্তে কোনো সহযোগিতা করতে পারেনি কমিশন।

ঘটনাটি ২০০৯ সালের। এরপর অজ্ঞাত মরদেহের পরিচয় শনাক্তে বারবার এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় পুলিশকে। অবশেষে ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর আঙুলের ছাপ যাচাইয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সমঝোতা সই হয়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করে পিবিআই।

এরপর থেকে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে বহু মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করেছে পিবিআই। মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে পরিবারে। ধরা হয়েছে অপরাধীদের।

২০১৯ সালের মার্চে খুলনার সোনাডাঙ্গায় দুটি প্লাস্টিকের ব্যাগে অজ্ঞাতপরিচয় একটি মরদেহের ১১টি টুকরা পাওয়া যায়। আঙুলের ছাপের সূত্র ধরে পিবিআই জানতে পারে মরদেহটি সাতক্ষীরার হাবিবুর রহমান (২৬) নামে এক ব্যক্তির। পরে তদন্তে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচ ব্যক্তি মরদেহ গুম করতে নৃশংসভাবে টুকরা টুকরা করে।

একই বছর গাজীপুর জাতীয় উদ্যান এলাকায় একটি পুকুরে অর্ধগলিত একটি মরদেহ পায় পুলিশ। শরীরে পচন ধরায় চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। পরে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই। আবদুল কাইয়ুম নামে ওই ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে জড়িত এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

জামালপুরের মেলান্দহ থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। পরে পিবিআই ওই তরুণীর স্বামীকে গ্রেফতার করে।

PBI

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন

এমন বহু ঘটনার তথ্য মিলেছে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই, অস্থায়ী ঠিকানায় বসবাসকারী মামলার সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা যাচাই, অপরাধ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক পরিচয় উদ্ধার ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বহনকারীদের শনাক্ত করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ (তথ্যভাণ্ডার) থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে অজ্ঞাত মরদেহের অধিকাংশেরই পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পিবিআই বলছে, এই তিন বছরে যতগুলো অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ তারা পেয়েছেন তার মাত্র ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশের পরিচয় মিলেছে। পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ৭৭.০৬ শতাংশের।

পিবিআই বলছে, নির্বাচন কমিশনে ভোটারদের আঙুলের ছাপ যাচাই করে গত তিন বছরের বেশি সময়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ৭১৪টি অজ্ঞাত মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করেছে পিবিআই। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১১৭ জন। যেখানে পুরুষ ৭৬ জন ও নারী ৪১ জন।

এ বিষয়ে পিবিআইপ্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, কোনো মরদেহের পরিচয় অজ্ঞাত থাকলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা যায় না। তাই প্রথমে তার নাম-পরিচয় জানাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ওই মরদেহের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আঙুলের ছাপের বিষয়টি আমার মাথায় আসে। ২০১৯ সালের আগে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ শনাক্ত করা কঠিন ছিল। নির্বাচন কমিশন আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের অনুমতি দেওয়ার পর পরিচয় শনাক্তের প্রযুক্তি নিয়ে আসে পিবিআই।

খুনের শিকার অজ্ঞাতপরিচয়দের হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে পরিচয় নিশ্চিত হওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন পিবিআইপ্রধান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ড বা দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের জানা দরকার তারা কাউকে হারিয়েছেন। এছাড়া নানা কারণে মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন। আঙুলের ছাপের মাধ্যমে যেমন অজ্ঞাতপরিচয় অনেক মরদেহ শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে, আবার অনেক খুনের মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পিবিআই। কিন্তু আমরা আকবর শাহ থানার সেই মেয়েটির পরিচয় আর বের করতে পারিনি। এটি এখনো আমাকে ব্যথিত করে।

PBI

জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্রে পাওয়া যায় আঙুলের ছাপ

পিবিআই ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের এনআইডি ও আঙুলের ছাপ শাখায় কর্মরত সার্জেন্ট মো. নাভিদ ইমতিয়াজ জানান, বর্তমানে পিবিআই হেডকোয়ার্টারসহ জেলা ও মেট্রো ইউনিট মিলে ৪৭টি ইউনিটে আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের ডিভাইসটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১১২টি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের আঙুলের ছাপ যাচাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭১৪টি আঙুলের ছাপ মিলেছে, ২ হাজার ৩৯৮টি মেলেনি। আঙুলের ছাপে মাত্র ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ মরদেহের পরিচয় পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ৭৭.০৬ শতাংশের।

পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, ৪০ বছরের কম বয়সী অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের আঙুলের ছাপ মিলছে সহজেই। তবে তারচেয়ে বেশি বয়সীদের বেলায় আঙুলের ছাপ মেলার হার খুবই কম। এছাড়া ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন ও ছিন্নমূল অনেক মানুষ এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রের আওতায় আসেনি। অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের অধিকাংশই এসব মানুষের। মরদেহগুলোর একাংশ বয়সে তরুণ, আবার অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এছাড়া শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ হাতের সাহায্যে কঠোর পরিশ্রম করেন। ফলে অনেক সময় তাদের আঙুলের ছাপ মেলে না।

বেশিরভাগ অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের আঙুলের ছাপ না মেলার কারণ জানতে চাইলে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ জাগো নিউজকে বলেন, আঙুলের ছাপ না মেলার মূল কারণটি আসলে একজন মানুষের আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যাওয়া। বেশি সময় পানিতে থাকা, পোকামাকড়ে খেয়ে ফেলাসহ নানা কারণে আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যায়। আর সার্ভারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপটি জীবিত মানুষের এবং ভালো ছাপটি রয়েছে। কিন্তু মারা যাওয়ার পর আমরা যেটা নিচ্ছি সেটা নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তাই আঙুলের ছাপ যথাযথভাবে মিলছে না।

আঙুলের ছাপ মেলার বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অশনাক্ত মরদেহের বয়স যাদের ৩০ বছরের নিচে তাদের আঙুলের ছাপ ৯৫ শতাংশ মিলে যাচ্ছে। বয়স যত বেশি হয় আঙুলের ছাপ তত কম মিলছে। বয়স বেশি হওয়ার সঙ্গে আঙুলের ছাপ নষ্ট হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কিত। আঙুলের ছাপ তখন অস্পষ্ট ও সমান হয়ে যায়। যারা কঠিন কাজ করে এ ধরনের মানুষের ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপের হার কম থাকে। যে মরদেহগুলো বিকৃত হয়ে যায় সেগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের আঙুলের ছাপটা নিতেই পারি না।

অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ শনাক্তের বিষয়ে মোস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, একটা আঙুলের ছাপ সার্ভারে আপ হওয়ার পর ফলাফল পেতে ইন্টারনেটে সমস্যা না হলে সাধারণত দুই থেকে তিন মিনিট লাগে। এতে আঙুলের ছাপ মিলে যাক বা না মিলুক। আর ইন্টারনেটের সমস্যা হলে সেটির সময় বেশি লাগে।

আরএসএম/এমএইচআর/এএসএ/এমএস

পিবিআই হেডকোয়ার্টারসহ ৪৭টি ইউনিটে আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের ডিভাইসটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১১২টি অজ্ঞাত মরদেহের আঙুলের ছাপ যাচাই

আঙুলের ছাপ না মেলার মূল কারণটি আসলে একজন মানুষের আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যাওয়া। বেশি সময় পানিতে থাকা, পোকামাকড়ে খেয়ে ফেলাসহ নানা কারণে আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যায়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।