‘অর্থসাশ্রয়ে’ মধ্যরাতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা!

রাত ১২টা বাজতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। ব্যস্ততম রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক এ সময় প্রায় জনমানবশূন্য। হাতেগোনা স্বল্পসংখ্যক যানবাহনকে দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে দেখা যায়। হঠাৎ করেই রাজধানীর মিরপুর রোডের নীলক্ষেত মোড়ের জ্বালানি তেলের পাম্পটিতে অসংখ্য মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারচালকদের ছুটে আসতে দেখা যায়। ক্ষণিকেই জনমানবশূন্য রাস্তাটিতে যানবাহনের হেডলাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠে।
শুরু হয় হৈ চৈ, চিৎকার চেঁচামেচি। কার আগে কে লাইনে দাঁড়াবে। এই যে ভাই, আমি সিরিয়ালে আগে, আমাকে দেন, গাড়ি ফুল ট্যাংকি ভরে দেন। পাশ থেকে আরেকজন চেঁচিয়ে উঠে বলেন, আরে ভাই, আপনার আগেতো আমি এসেছি। সিরিয়ালি ঠিকঠাক মতো আসেন, নাহলে খারাপ হইবো কিন্তু। আরেক তরুণকে তেলের গ্যালন উঁচিয়ে পাম্প অপারেটরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
এ সময় অসংখ্য মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো, শত শত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে একটি মোটরসাইকেলে এক ভদ্রলোকের সামনে বসা ছোট্ট শিশুকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলতে শোনা যায়— বাবা, সবাই এমন করছে কেন?
এই চলতো, এত ভিড়ের মধ্যে তুমি তেল নিতে পারবে না, সিরিয়ালে পেছনে থাকা একজন মোটরসাইকেল আরোহীর পেছনে বসা এক নারীকে এমন কথা বলতে শোনা যায়। উত্তরে ভদ্রলোক বলছিলেন, 'কি বলছো, ঘণ্টাখানেক পরে লিটারপ্রতি ৪৪ টাকা বেশি গুণতে হবে।’
শুক্রবার (৫ আগস্ট) রাত আনুমানিক রাত ১১টায় রাজধানীর মিরপুর রোডের নীলক্ষেত মোড়ের জ্বালানি তেল বিক্রির পাম্পটিতে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। স্বাধীনতাত্তোরকালে জ্বালানি তেলের দাম বিভিন্ন সময় বাড়ানো হলেও গতকাল পেট্রল, অকটেন, ডিজেল এবং কেরোসিনের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ার খবরে রাজধানীর বিভিন্ন পেট্রলপাম্পে শত শত যানবাহনের মালিক ছুটে আসেন।
লিটারপ্রতি ৩৪টাকা থেকে ৪৬ টাকা সাশ্রয়ের জন্য ছুটে আসেন তারা। কিন্তু তাদের অধিকাংশকেই জ্বালানি না পেয়েই ফিরে যেতে হয়। জ্বালানি তেলের মজুত শেষ হয়ে গেছে এমন অজুহাত দেখিয়ে রাত ১২টার আগেই পাম্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। অসংখ্য যানবাহন মালিককে শেষবারের মতো জ্বালানি দেওয়ার জন্য পাম্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুরোধ উপরোধ করতে দেখা যায়।
শুক্রবার (৫ আগস্ট) রাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল-ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন, ও অকটেনের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, শুক্রবার মধ্যরাত অর্থাৎ রাত ১২টার পর থেকে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রলে ৪৪ টাকা দাম বাড়ছে। দাম বাড়ার পর প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা ও প্রতি লিটার পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হবে। আগে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রল ৮৬ টাকা।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ জানায়, বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় বিপিসি, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রলের মূল্য সমন্বয় করা হয়।এর আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা করে সরকার। তবে, অকটেন ও পেট্রলের দাম অপরিবর্তিত ছিল।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে নীলক্ষেত জ্বালানি তেলের পাম্পে আগত যানবাহন মালিকদের সঙ্গে আলাপকালে আকস্মিক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় সবার মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।
তারা ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেছেন, দেশ কী তাহলে শ্রীলঙ্কার মতোই হতে যাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী তো কয়েকদিন আগেই বললেন, দেশে পেট্রল ও অকটেনের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সরকারের কথা ও কাজে মিল নেই বলেও অনেকেই উস্মা প্রকাশ করেন।
রাজধানীর লালবাগের হাফিজউদ্দিন জানান, তার এক ভাই তাকে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে পেট্রলের দাম বাড়ার কথা জানিয়ে দ্রুত পাম্পে গিয়ে ট্যাংকি ফুল করে রাখার পরামর্শ দেন। লালবাগ থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে এসে দেখেন এলাহি কাণ্ড, তার আগেই শত শত মোটরসাইকেল আরোহী লাইনে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন।
তিনি বলেন, গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অফিস থেকে জ্বালানি তেলের যে খরচ দেওয়া হয় তা দিয়ে আগেই চলতে পারতেন না। বেতনের টাকা থেকে জ্বালানি কেনা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুণতে হতো। আর এখন লিটার প্রতি ৪৪টাকা গুণতে হলে আরও কত টাকা বেশি গুণতে হবে তা ভেবে তার মধ্য একধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
১০লিটারের সয়াবিন তেলের গ্যালন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা আতাহার আলী। গরমে ঘেমে সারা শরীর ভিজে চুপচুপ। নীলক্ষেতের পেট্রল পাম্পের এক কর্মচারী তার পূর্বপরিচিত। তিনি সিরিয়ালের পেছন থেকে বার বার পরিচিত কর্মচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ওই কর্মচারী তখন লাইনের ভিড় সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আতাহার আলী বলেন, ঘরে সয়াবিন তেল ছিল না। মার্কেট থেকে ফিরে গৃহিণী তাকে তেল আনতে পাঠিয়েছিলেন। পথে পরিচিত একজন পেট্রলের দাম বেড়েছে এমন সংবাদ দিলে তিনি তেলের গ্যালন নিয়ে ছুটে আসেন। পাম্পের কর্মচারী পূর্বপরিচিত হলেও প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে তিনি পেট্রলসংগ্রহ করতে পারেননি বলেও জানান।
এমইউ/এমএএইচ/এমএস