দেশে ধর্ষণ কমছে!

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪০ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২৩

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে যান ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। সেখানে ধর্ষণ করা হয় ওই তরুণীকে। এর সপ্তাহখানেক পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আরেক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। এমন কয়েকটি ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনায় আলোচনায় আসে ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের সংশোধন। সারাদেশে এ নিয়ে আন্দোলনের পর ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’।

নতুন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড- এর স্থলে ‘মৃত্যুদণ্ড- বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়। আইন পাস হওয়ার পর পেরিয়েছে ২ বছর ৩ মাস। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই দুই বছরেই ধর্ষণের ঘটনা কমেছে ধারাবাহিকভাবে।

তবে এই ‘কমে আসা’ নতুন আইনের ফলেই কি না, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মত পাওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবাদে কমেছে এ ধরনের দুর্ঘটনা।

অন্যদিকে নারী নেত্রীরা বলছেন, অপরাধ কমার তথ্য সঠিক নয়। ধর্ষণের খবর হয়তো আসছে না, তবে ধর্ষণ হচ্ছে ঠিকই।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৩৭০ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০২০ সালে হয়েছেন ১ হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ২৩৫ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ৯৮৭ জন। চলতি বছরের গত দুই মাসে ৯৮ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

আরও পড়ুন: কোনো মন্তব্য করতে চাই না : রায় প্রসঙ্গে এমসি কলেজ অধ্যক্ষ

অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন নারী। ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৯৩৬ জন। ২০২৩ সালের দুই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২১ সালে রাজধানীতে ৫৪৬টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। ২০২২ সালে হয়েছে ৪৩১টি মামলা। অর্থাৎ ঢাকায় ধর্ষণের মামলা কমেছে ১১৫টি।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী কমেছে ধর্ষণ। এর কারণ জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক (কর্মসূচি) নীনা গোস্বামী জাগো নিউজকে বলেন, কোনো কারণ বিশ্লেষণ ছাড়া বলা যাবে না। তবে রিপোর্টেড কেসের সংখ্যা কমে আসছে। ২০২১ সালের তুলনায় অবশ্যই কিছুটা কমে আসছে। কারণ আমরা গবেষণা ছাড়া বলতে পারি না। তবে হতে পারে ধর্ষণবিরোধী একটি আন্দোলন হওয়ায় প্রচার হয়েছে। আইনেরও সংশোধন হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে।

সংস্থা দুটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইনটি পরিবর্তনের পর গত দুই বছরে দেশে ২৫০ থেকে ৩০০টি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে। এক্ষেত্রে আইনের পাশাপাশি প্রভাব পড়েছে ধর্ষণবিরোধী নানান সামাজিক সচেতনতা ও ভুক্তভোগী নারীদের কার্যকর পদক্ষেপ। আগে যেখানে অনেকেই নীরবে এসব ধর্ষণ ও হয়রানি মেনে নিতেন, সেখানে এখন ধর্ষণের শিকার বা হুমকির মুখে পড়লে নেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা।

আরও পড়ুন: ধর্ষণ মামলায় কারাগারে সাবেক এমপি আরজু

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ধর্ষণের শিকার বা হুমকির মধ্যে পড়ে কোনো নারী জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯- এ সহযোগিতা চাইলে ত্বরিত পদক্ষেপ নেন তারা। ফলে নারীদের সহযোগিতা চাওয়ার পরিমাণও অনেক বেড়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি ফোন আসে। আর ২০২১ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ১৬৯টি। ২০২২ সালে কল আসে ২০ হাজার ২৫১টি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৫০টি ফোনকল আসে।

jagonews24

পুলিশের সহযোগিতা পেয়ে ২০২১ ও ২০২২ সালে ৯২০ জন ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় ফোনকল আসে ৬১৬টি।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৭ সালে এ সেবা চালুর পর এতটা জনপ্রিয় ছিল না। আগে নারীরাও এত সচেতন ছিলেন না। ফলে ফোনকলের সংখ্যাও কম ছিল। এখন গৃহকর্মী থেকে উচ্চশিক্ষিত অনেকেই ফোন দেন। আমরাও চেষ্টা করি ধর্ষণের মতো অপরাধে কোনো নারী সহযোগিতা চাইলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। এটার এক ধরনের প্রভাব হয়তো পড়েছে ধর্ষণের ঘটনা কমার ক্ষেত্রে।

তবে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান দেশের সার্বিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ২০২৩ সালে এসে আমরা দেখছি ধর্ষণ কম, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সঠিক তথ্যটা আমরা পাই না। পত্রিকায় যে তথ্য আসে সেটি আমরা জানতে পারি। কিন্তু এটি প্রকৃত চিত্র নয়। বর্তমানে দেশে রাজনীতি নিয়ে নানান হইচইয়ের ফলে ধর্ষণের সংবাদ হয়তো আসছে না। আইনে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে তা নয়।

আরও পড়ুন: প্রেমিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ, ৯৯৯-এ কল দিয়ে প্রেমিককে আটক

তিনি বলেন, অপরাধ আর ক্ষমতা দুটো হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলছে। ধর্ষণের সঙ্গে যারা সমাজে প্রভাবশালী তারাই যুক্ত থাকেন। ফলে ধর্ষণের অপরাধ দমন করতে পারছি না। তাই দ্রুত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, আইনে শাস্তি আরও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা হয় বিশেষ কারণে। যে প্রচলিত শাস্তি, তার মাধ্যমে হয়তো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যখনই আইনের ধারা পরিবর্তন করে শাস্তি বাড়ানো হলো, এরপরই অপরাধ কিছুটা কমেছে। আসলে উদ্দেশ্যই ছিল অপরাধ কমানো। কমেছে, এটি অবশ্যই ইতিবাচক।

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, আইনের আশ্রয় অনেকেই নিতে পারছেন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপব্যবহারও হচ্ছে। এই আইনটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অনেক জায়গায় হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলাও হচ্ছে। আদালতে এ সংক্রান্ত যে মামলা আসছে সেগুলো থেকেও আমরা বুঝতে পারি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আরও ইতিবাচক পর্যায়ে হয়তো আসবে।

আরএসএম/এমএইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।