নিউ সুপার মার্কেটে আগুন
মেলেনি ক্ষতিপূরণ, ঈদের আগে দোকান খোলা নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
#গত ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে
#আগুনে ২৩০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়
#শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত, দাবি তদন্ত কমিটির
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের দক্ষিণ ভবনে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে ২৩০টি দোকান। পুড়ে ছাই হয়েছে এসব দোকানের ওপর নির্ভর করে জীবিকা চালানো অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন। প্রায় ৪০ দিন পার হলেও পুড়ে যাওয়া ২৩০টি দোকান সংস্কারে এখনো উদ্যোগ নেয়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তাও করেনি সংস্থাটি। ফলে আসন্ন ঈদুল আজহার আগে দোকান চালু করা নিয়ে শঙ্কায় তারা।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অগ্নিকাণ্ডের পর ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে’ সিটি করপোরেশন থেকে শুধু একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কীভাবে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন বা তাদের আর্থিক সহায়তার বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। অথচ ওই মার্কেট থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে ডিএসসিসি।
তবে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট দক্ষিণের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করেছেন। তদন্ত কমিটির সুপারিশে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইতিবাচক। তবে ঠিক কবে নাগাদ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন বা মার্কেটটি সংস্কার করা হবে তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেনি।
আরও পড়ুন>> ঢাকা নিউমার্কেটে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ২৮ ইউনিট
গত ১৫ এপ্রিল ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউমার্কেট সংলগ্ন ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে (দক্ষিণ) আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। তখন আগুনে মার্কেটের তৃতীয় তলায় কমপক্ষে ২৩০টি দোকান পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের পানি ব্যবহারে আরও ৭০টি দোকানের মালামাল, ডেকোরেশন নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের বেশিরভাগই কাপড়ের। তবে চারতলা মার্কেটটিতে মোট এক হাজার ২৪০টি দোকান রয়েছে। বাকি দোকানগুলো অক্ষত রয়েছে।
ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১৬ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে সংগঠিত অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএসসিসি। এ কমিটিতে করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীনকে আহ্বায়ক এবং প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীনকে সদস্যসচিব করা হয়। তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। তবে প্রতিবেদনটি এখনো প্রকাশ করেনি ডিএসসিসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির অঞ্চল-১–এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মেরীনা নাজনীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কিছুদিন পরই ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রে যেমন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সাহায়তা আসছে, নিউ সুপার মার্কেটের ক্ষেত্রে তেমন সারা মেলেনি। তবে এ অগ্নিকাণ্ডে নিউ সুপার মার্কেটে আর্থিক ক্ষতি ৩০ কোটি টাকার মতো হবে। আমাদের তদন্ত কমিটির সুপারিশে ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৯ সদস্যের কমিটি
আগুনের সূত্রপাত উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মেরীনা নাজনীন বলেন, ‘ওই মার্কেটে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে এমনটি উল্লেখ রয়েছে। তবে একই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, সিআইডিসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থা অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তাদের রিপোর্টগুলো এখনো ডিএসসিসিতে জমা দেয়নি। সবগুলো রিপোর্ট এক সঙ্গে করা হলে অগ্নিকাণ্ডের চূড়ান্ত কারণ বের করা যাবে। এছাড়া এ অগ্নিকাণ্ড ইচ্ছাকৃত ছিল কি না, তাও বেড়িয়ে আসবে।’
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন লেগেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলো নিজ উদ্যোগে সংস্কার করছেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে আবার মালামাল তুলে বেচা-বিক্রিও শুরু করেছেন। তবে সবগুলো দোকান সংস্কার শেষ হলে আগের মতোই ব্যবসা জমে উঠবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে এখনো মার্কেটটির তৃতীয় তলার দোকানগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা মার্কেটের বণিক সমিতির কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন>> নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জিডি
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি আলাউদ্দিন বলেন, ‘দোকানে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দেওয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়ছে। কিন্তু দোকানগুলো সংস্কারে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা দেখছি না। অথচ আগুনের কারণে গত ঈদুল ফিতরে বেচাকেনা করতে পারিনি। আসন্ন ঈদুল আজহার বাজার ধরার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘এ মার্কেট থেকে বছরে আড়াই কোটি টাকা সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব দেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্রতিটি ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে আরও তিন হাজার টাকা করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এত টাকা সরকারকে দেওয়ার পরও তাদের কেউ এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করেনি।’
গত এপ্রিলের শেষ দিকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে দোকান মালিক সমিতির নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। অগ্নিকাণ্ডের কারণে এ নির্বাচন স্থগিত করা হয়। আগামী ৬ জুন নতুন করে নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে মার্কেটের অবকাঠামো উন্নয়নে ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা।
আরও পড়ুন>> একপাশে শোক-পোড়া কাপড়, অন্যপাশে কেনাকাটার ধুম
এ মার্কেটের হাবিব গার্মেন্টসের মালিক ফজলুর হক। তিনি দোকান মালিক সমিতির সাবেক নেতা। আলাপকালে ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের কিছুদিন পর স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের ৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন এখনো কোনো সহায়তা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আসন্ন নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।’
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি শহিদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের প্রায় দেড় মাস পরও সিটি করপোরেশন বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেয়নি। মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলোও সংস্কার করে দেয়নি। এমন অবস্থায় নিজ উদ্যোগ ২৩০টি দোকান সংস্কার করছেন মালিকরা। এখন ডেকোরেশনের কাজ চলছে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সবগুলো দোকান চালু করা সম্ভব হবে।’
১৫ এপ্রিল শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউমার্কেটের নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার তথ্য জানতে পারে ফায়ার সার্ভিস। ৫টা ৪৩ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এরপর একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সকাল ৯টা ১০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
এমএমএ/ইএ/জিকেএস