‘চাইল পাইছি তাই ব্যাগ বড়, যতই কষ্ট হোক খেয়ে বাঁচমু’

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৩
সংগৃহীত ছবি

দুপুর ১২টা। হাজিপাড়া বৌবাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রি চলছে। পণ্যের ব্যাগটি পাশে রেখে হাঁপাচ্ছিলেন খালেদা আক্তার। তপ্ত দুপুরের পঞ্চাশোর্ধ্ব এ নারীর জন্য ওই বড় ব্যাগটি বয়ে নেওয়া দারুণ কষ্টসাধ্য। তারপরেও তিনি আত্মতৃপ্তি জানিয়ে বললেন, ‘চাইল পাইছি তাই এবার ব্যাগ বড়। নিতে ভারী লাগে, কিন্তু যতই কষ্ট হোক এবার খেয়ে বাঁচমু। আর মানুষের কাছে হাত পাততে হইবো না।’

একথা বলে এগিয়ে গেলেন তিনি। কয়েক হাত দূরে ডিলারের বিক্রয় কেন্দ্রে তখনও শতাধিক নারী-পুরুষের লম্বা লাইন। ওইদিন (সোমবার) সকাল ৯টা থেকে সেখানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি চলছে। তেল, চিনি ও মসুর ডালের সঙ্গে এবার প্রথমবারের মতো ফ্যামিলি কার্ডধারীরা পাচ্ছেন পাঁচ কেজি করে চাল। দাম প্রতি কেজি ৩০ টাকা।

আয়েজ উদ্দিন নামে একজন বলেন, দেড়শো টাকায় যে পাঁচ কেজি চাল দিচ্ছে বাজারে এর দাম ৩শ টাকা। চালও ভালো। মাল (পণ্য) পেতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু খুব ভালো লাগছে চাল পেয়ে। এখন গরিবের অনেক কষ্ট কমবে।

আরও পড়ুন>> টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডে মিলবে চালও

প্রথমবার চাল দেওয়ার এ কার্যক্রমে রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ক্লান্ত। তবে পণ্য পেয়েও খুশির কথা জানান অধিকাংশই। লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন এমন আরও কয়েকজনের ভাষ্য, টিসিবির এ উদ্যোগ খুব ভালো। গরিব মানুষের জন্য চালটাই প্রধান। তবে আরেকটু পরিমাণ বাড়ালে ভালো হতো। দাম কিছুটা কমলে মহাখুশি হতেন তারা।

টিসিবির পাশাপাশি সরকারের খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি কার্যক্রমেও (ওএমএস) চাল দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকেও অনেকে আরও পাঁচ কেজি চাল পাবেন। এতে তাদের প্রায় মাসের অনেকটা পেরিয়ে যাবে।

এনামুল হক নামে একজন বলেন, পরিবারে মাসে ১৫ কেজি চাল লাগে। দুই জায়গা থেকে নিতে পারলে অনেকটা চাপ কমে যাবে। আগেও টিসিবির পণ্যের জন্য লাইন দিতে হতো। এখন থেকে চাল পেয়ে সময় বাঁচবে।

টিসিবির কার্ডধারী আরও দুই ব্যক্তি জানান, ওএমএস এর চাল নিতেও সকালে লাইন দিতে হয়। আবার পাওয়া যায় না অনেক সময়। তারা দিনমজুর। সকালে চালের জন্য লাইন দিতে গেলে সময় চলে যায়, ওইদিন কাজ মেলে না। টিসিবির কার্ডের চাল পেলে তাদের ওএমএসে বাড়তি সময় দিতে হবে না।

আরও পড়ুন>> জুলাই থেকে টিসিবির কার্ডধারী ১ কোটি পরিবার পাবে ওএমএসের চাল

এদিকে চাল বিক্রি শুরু হওয়ার পরে টিসিবির ডিলারদের বিক্রয় কেন্দ্রেও মানুষের চাপ বেড়েছে। পাশের রামপুরা জামতলা এলাকায়ও টিসিবির পণ্য বিক্রি চলছিল। সেখানেও দেখা যায়, কয়েকশ মানুষের হুড়োহুড়ি। তপ্ত রোদের কারণে অনেকের হাতেই ছাতা। ঘেমে আবার তাদের হাতে থাকা ব্যাগ দিয়ে কেউ কেউ বাতাস খাচ্ছেন।

‘চাইল পাইছি তাই ব্যাগ বড়, যতই কষ্ট হোক খেয়ে বাঁচমু’

লাইন দিয়ে অনেকে ভিড় কমার অপেক্ষায় কিছুটা দূরে সুবিধাজনক স্থানে বসে আছেন। নিজের কার্ড নিজে এনেছেন কেউ, আবার কেউ বাবা-মা বা অন্যের কার্ড নিয়ে এসেছেন। ডিলারের লোকজন বারবার লাইন সোজা করছেন। তারপরেও বিক্রয় কেন্দ্রের মুখে গিয়ে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে হুড়োহুড়ি লাগছে। চিল্লাচিল্লি করে তা শান্ত করছেন ডিলারের লোকরা।

ডিলার আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চাল দেওয়ায় একটু সময় বেশি লাগছে। ওজন করতে, ব্যাগ ভরতে। এ কারণে চাপ বেশি। সেই ধৈর্য মানুষের মধ্যে নেই।

জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, যে চাল দেওয়া হচ্ছে এসব থাইল্যান্ড থেকে সরকার আমদানি করেছে। চিকন ও পরিষ্কার। তবে শুনেছি, ভাত বেশিক্ষণ থাকে না। এটাই একটু সমস্যা। এছাড়া সব ভালো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ডিলার জানান, চাল দেওয়ার কারণে ভিন্ন ধরনের কিছু সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। এতে যেসব বড়লোক মানুষ কমিশনারের সঙ্গে আঁতাত করে ফ্যামিলি কার্ড নিয়েছে, তারা বিপদে পড়বে। তারা এ চাল খাবে না। তারা ভালো চাল খায়। বেচতেও পারবে না। এতে অনেক কার্ডধারী পণ্য ওঠাবে না বলে আশঙ্কা তার।

‘চাইল পাইছি তাই ব্যাগ বড়, যতই কষ্ট হোক খেয়ে বাঁচমু’

কয়েকজন ডিলার জানান, চালের কারণে তাদের বাড়তি গুদাম ভাড়া গুনতে হবে। আগের ছোট স্থাপনায় বিক্রি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অনেকে ছোট ছোট দোকানে পণ্য বিক্রি করতেন। যেখানে এখন এত চাল রাখা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন>> টিসিবির মাধ্যমে চাল বিতরণ প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তার ফল

চলতি মাস (১৬ জুলাই) থেকে প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী এক কোটি উপকারভোগী পরিবারের কাছে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির চিনি, মসুর ডাল ও ভোজ্যতেলের সঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তররের চালও বিক্রি শুরু হয়েছে। এখন থেকে টিসিবির পণ্যের সঙ্গে প্রতি মাসে প্রতিটি ফ্যামিলি কার্ডধারী পাঁচ কেজি করে চাল পাবেন। কার্ডধারীরা নিজ নিজ এলাকার পরিবেশকদের দোকান বা নির্ধারিত জায়গা থেকে চালসহ অন্য পণ্য নিতে পারছেন।

টিসিবি এখন চালের জন্য বরাদ্দপত্র তৈরি করে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি অফিস, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক/উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পাঠাচ্ছে। এরপর ওএমএসের ডিলাররা টিসিবির ডিলারদের বরাদ্দপত্র মোতাবেক চাল দিচ্ছে। টিসিবির ডিলাররা তাদের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র বা দোকানে সেগুলো বিক্রি করছেন। টিসিবির ডিলার চালের জন্য প্রতি কেজি দুই টাকা হারে কমিশন পাচ্ছেন।

‘চাইল পাইছি তাই ব্যাগ বড়, যতই কষ্ট হোক খেয়ে বাঁচমু’

বর্তমানে এক কোটি কার্ডধারীকে প্রতি মাসে অন্তত একবার বিভিন্ন পণ্য দিচ্ছে টিসিবি। এর মধ্যে একজন ক্রেতা চালসহ দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি করে ডাল ও এক কেজি চিনি পাচ্ছেন।

ভোক্তা সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতিতে সংসার খরচের চাপ কমাতে টিসিবির চালে কিছুটা স্বস্তি পাবে মানুষ। কারণ ঢাকার বাজারে এখন মোটা চালের দামও কেজিপ্রতি ৫৫ টাকায় উঠেছে, যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে চাল দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষ সুফল পাবে। তবে গরিবদের টিসিবির কার্ডধারী বানাতে হবে। এক্ষেত্রে আবার কিছু সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। এখনো অধিকাংশ গরিব মানুষ কার্ড পায়নি।

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।