পেঁয়াজের ঝাঁজ নিস্তেজ ক্রিকেট
বেশিরভাগ সময় আমরা চোখ বুজে থাকতে চাই। কিন্তু মুখটাকে সচল রাখি। এতে দুটো লাভ।
এক. সমস্যার স্বরূপ দেখতে হয় না। সমস্যার কারণ খুঁজতে হয় না। অথচ মুখে অনেক কিছু বলা যায়। এটা বাঙালির স্বভাবগত সমস্যা। সেটা পেয়াঁজের দাম বাড়া থেকে ইন্দোরে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে বাংলাদেশের ইনিংসের হার। তাই সমস্যার স্বরূপ চেনাতে মুখের সামনে আয়না ধরতে হয়। যদি তাতে কিছুটা কাজ হয়।
দুই. মুখ সচল থাকলে কথাগুলোকে ব্যর্থতা ঢাকার হেলমেট বানানো যায়। পেঁয়াজের দাম ডাবল সেঞ্চুরি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কেন? উত্তর সহজ। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল! পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। অতএব পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ! এটাই একমাত্র সমাধান। না কী কেন দাম হঠাৎ এক্সপ্রেস গতিতে বেড়ে গেল তার কারণ খোঁজা! ডাবল সেঞ্চুরি পেরিয়ে পেঁয়াজের কেজি আড়াইশ টাকা। কোথাও তার চেয়ে বেশি। আর ইন্দোর টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে টেনেটুনে ডাবল সেঞ্চুরি করল বাংলাদেশ টিমের সবাই মিলে! তারপরও স্কোর কার্ড নামক আয়না যখন চোখের সামনে ধরা হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার ইনিংস ব্যবধানে।হারের স্বরূপ উদ্ঘাটনের দরকার পড়ছে না। মুখ সচল আমাদের। এক একজন এক একরকম ব্যাখ্যা দাঁড় করাছি। তবে সবচেয়ে সহজ-সরল বাজার চলতি উত্তরটা দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি নিজে। ‘আমরা এখনো টেস্ট টিম হয়ে উঠিনি। আরো অন্তত বছর দেড়েক সময় লাগবে।’
তবু ভাল। এটা এক ধরনের আত্মোপলব্ধি। আরও ভাল আম্পায়ারিং নিয়ে সরকারিভাবে বির্তকের কোন কাঁটা বেঁধা হয়নি এই ম্যাচের গায়ে। ইদানিং বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে অদ্ভুদ একটা বৈরিতা তৈরি হচ্ছে। যা খেলাটা কিংবা প্রতিবেশী দুটো দেশের সর্ম্পক উন্নয়নের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর কিছু নয়। ইন্দোর টেস্টে বাংলাদেশ হেরেছে। একটা দল হারলে আরেকটা দল জিতবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে সহজ পাটীগণিত দুটো দলের মধ্যে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য এত বেশি, যেখানে ভারতের জয়টাকে অস্বাভাবিক মনে হবে না। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে এখনও পর্যন্ত তাদের খেলা ছয়টি টেস্টই তারা জিতেছে। পয়েন্ট তালিকায় অন্যদের চেয়ে এত এগিয়ে যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশের মত ছয়টা দেশের পয়েন্ট যোগ করলেও ভারতের সমান হচ্ছে না! তাই ইন্দোরে বাংলাদেশের হার নিয়ে হাহুতাশ করার তেমন কিছু নেই।
তবে এই হারে হতাশা অবশ্যই আছে। দুই দশক ধরে টেস্ট খেলা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাঝে লড়াকু মনোভাবটা দেখা গেলো না। ইন্দোরে জয় না হোক, এক লড়াকু দেশের বেঁচে ওঠার গান নিশ্চয়ই খুঁজেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। দেখতে চেয়েছিল ক্রিকেট শৌর্য। কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল কিছু? দেখা কী গেল কোন লড়াই! বরং দেখা গেল টেস্ট ক্রিকেটে খুব অসহায় এক বাংলাদেশকে। নিজেদের এই অসহায়ত্বের কারণ খোঁজা জরুরি। দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর তৃপ্তির রেশ এখনও অনেকে খোঁজার চেষ্টা করেন। সেটা মনে করেই; ভাবতে শুরু করি ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়াকে তিন-দিন চারদিনের মধ্যে হারাতে পারলে, ভারতের বিপক্ষে জিততে পারব না কেন?
অপ্রিয় উত্তর একটাই। হাঁটুর নিচে বল থাকবে এমন উইকেট বানাবো। যেখানে প্রথম দিন থেকে বল লাড্ডুর মত ঘুরবে। অন্যরা খারাপ খেলবে। আর তার মধ্যে দিয়ে আমাদের জয়ের আশা ফুটে বের হবে। অন্যদের খারাপ খেলার ওপর নিজেদের জয়ের স্বপ্ন দেখা আর যাই হোক ভাল কোন টেস্ট প্লেয়িং দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি হতে পারে না। এটা মেনে নিয়ে যদি বলা হয়; ‘আমরা এখনও টেস্ট টিম হয়ে উঠতে পারিনি।’ তাহলে সেটা দেশজ ক্রিকেটের জন্য একটা ইতিবাচক বার্তা মনে হবে।
বিরাট কোহলির ভারত এখন নির্মম-আগ্রাসী ক্রিকেট খেলছে। স্বপ্নের মত সময় পার করছে তারা। যা অন্যদের দুঃস্বপ্নের কারণ। তবে এটাও ঠিক টেস্টে আমরা বাজে ক্রিকেট খেলছি। যেখানে এখনও উন্নতির ছোঁয়া সেভাবে লাগেনি। তার বড় একটা কারণ আমাদের মানসিকতা। একটা ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি জিতলেই আমরা বিশ্ব জয়ের আবেগের জোয়ারে ভাসি। ভুলে যাই; ক্রিকেটের আসল খেলাটার নাম- টেস্ট।
একটা দুটো ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির পাশে নিজের মাটিতে আনস্পোর্টিং পিচে গোটা কয়েক টেস্ট জেতার কৌশলকে ক্রিকেটারদের জন্য পাঠ্যপুস্তক বানিয়ে ফেললে ইন্দোরের মত আরও অনেক জায়গায় নিজেদের আনকোরা মনে হবে। এই চিন্তার ক্ষুদ্রতা দিয়ে নিজেদের ক্রিকেট বীরত্ব দেখানো যায় না। লক্ষ বীরের রক্তে কেনা দেশের ক্রিকেটাররা এমন ক্রিকেট খেলুক; যেখানে হারলেও তাদের আত্মা খুশি হবে।
অনেকে বলবেন সময় পাল্টে গেছে। এখন পাল্টে গেছে টেস্ট ক্রিকেটও। আধুনিক ক্রিকেট সংস্কৃতিতে নির্মমতা, আগ্রাসী মনোভাব, দুর্দান্ত ফিটনেস এগুলো হচ্ছে ম্যাচ জয়ের ‘ল্যাব রিপোর্ট’। এই রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে বলব; যদি জিততে না পারেন, অন্তত রোমাঞ্চ ছড়ানো মুগ্ধতা জড়ানো ক্রিকেটটা খেলেন। বাঙালির ক্রিকেট অনুরাগকে কিছুটা সম্মান দেখান।
বাঙালির মানসিকতার উল্টো পিঠটাও দেখে ফেলছি আমরা। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। অতএব রান্নাঘরে আর পেঁয়াজ নয়! টেস্টে হেরেছে? তাহলে আর টেস্ট নয়! মুখ ফসকে এমন কথাও বলতে পারেন অনেকে।
পুনশ্চঃ বাঙালি ফলটা দেখে। কারণ খুঁজতে আগ্রহী নয়।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর