ইসরায়েলের গণহত্যা ও শব্দের আধিপত্য ৪

মানবাধিকারের সংজ্ঞা

মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুন মুনতাসীর মামুন
প্রকাশিত: ০৫:০১ পিএম, ১৯ মে ২০২৪

যখন স্কুলে পড়ি তখন দুটি শব্দ এই ভূখণ্ডে এসেও পৌঁছেছিল। আজ থেকে ৬০ বছর আগের কথা লিখছি। এ ভূখণ্ড তখন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ, যে দেশের মানুষরে সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। শব্দ দুটির একটি হলো ‘আগলি আমেরিকান’, অন্যটি ‘রাশানস আর কামিং রাশানস আর কামিং’।

দুটি শব্দেরই উদ্ভব খুব সম্ভব আমেরিকায়। ‘আগলি আমেরিকান’ এর অর্থ আমেরিকানরা কোথাও আদৃত নয়। তারা বিশ্বে নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। খুব সম্ভব ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াও এর একটি কারণ। আমেরিকা কখনও চিন-রাশিয়াকে পছন্দ করেনি। রাশিয়াকে তো নয়ই। কারণ, তারা পুঁজিবাদের বিকল্প দাঁড় করিয়েছিল।

রুশরা হলো ‘ইভিল’। তারা আসছে সব ধ্বংস করতে। অতএব সাবধান! সাবধান! চলচ্চিত্র, প্রতিবেদন, উপন্যাস, নানা মাধ্যম শব্দ দুটি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এ শব্দ দুটি নিয়েও আমরা বড় হয়েছিলাম। আমেরিকান আগলি হলেও তার প্রতি আকর্ষণ কারো হারায়নি, আসলে মানুষ একেবারে নিঃস্ব হলেও নিজের কিছু চায়। তাদের ধারণা সমাজতন্ত্রে নিজস্ব কিছু থাকে না, তাই সমাজতন্ত্র পরিত্যাজ্য।

আজ ষাটবছর পর মনে হচ্ছে আবার শব্দ দুটি পুনরুজ্জীবিত হবে। ইসরায়েলি গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের সমর্থন এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার থাবা আবারও আমাদেরকে শব্দ দুটির সম্মুখীন হতে হবে। গণহত্যা মধ্যপ্রাচ্যে চলবে যতদিন ইসরায়েল থাকবে। যতদিন মধ্যপ্রাচ্য রাজা বাদশা ও সামরিক শাসকরা থাকবেন ততদিন ইসরায়েল প্রাধান্য বিস্তার করবে।

প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের স্বার্থ সুরক্ষা দেবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে হুকুম করে। কিন্তু, একটা সময় প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রও হবে, খানিকটা স্থিতিশীলতাও আসবে। কিন্তু, তখন বিশ্বে পাশ্চাত্য ও মার্কিন নাগরিকরা ঐ ধরনের কোনো সম্বোধনের সম্মুখীন হবেন, নাজেহাল হবেন। এর প্রধান কারণ, সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক শব্দকে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

আগে কিছুটা রাখঢাক ছিল এই অস্ত্র ব্যবহারে। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। হ্যান্স আন্ডারসেনের রাজার নতুন পোষাক গল্পটির কথা মনে পড়ছে। রাজা হাঁটছেন তার সঙ্গীসাবুদ নিয়ে, ভাবছেন জাঁকালো পোশাক পরে আছেন। আসলে তিনি তো নগ্ন এবং তিনি যে নগ্ন সে বোধও তার নেই। যে শব্দটি আজকের আলোচনার বিষয় তাহলো মানবাধিকার।

মার্কিন জনপ্রতিনিধিদের কাছে, মার্কিন সরকারের কাছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে মানবাধিকার প্রশ্নটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের পত্রিকা খুললেই দেখি, মার্কিন সরকার বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন উঠিয়েছে। কেউ গুম হয়েছে, কারো বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে, হয়ত বিরোধী কারো বিরুদ্ধে, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, কেনো সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে?

এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে স্টান্ডার্ড একটি উত্তর আছে, এটি আমাদের সংবিধান সংশ্লিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রে যখন কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশ মাটিতে চেপে শ্বাসরোধ করে, বা পেটায় তখন মানবাধিকারের প্রশ্ন ওঠে না বা ওঠানো হয়নি। মার্কিন ও পাশ্চাত্যের কিছু মানবাধিকার সংস্থা আছে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেরও কোনো কোনো সংস্থার যোগাযোগ থাকতে পারে, নিয়ত যারা মানবাধিকারের প্রশ্ন ওঠায়।

ঢাকা দখলে যখন হেফাজত বিএনপি জাতীয়পার্টি অভিযান চালায় তখন সরকার তাদের হটিয়ে দেয়। একটি জাসদ ঘেঁষা মানবাধিকার সংস্থা পৃথিবীব্যাপী জানাতে থাকে, অনেক হেজাবী হত্যা করা হয়েছে, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে দেখে এগুলো সব বানানো তথ্য। কিন্তু সেই সব ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা’ সে নিয়ে কী না তুলকালাম কান্ড করল!

আমি এসব সংস্থা বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তুমুল সমালোচনা করছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি, অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থা যদি দেখে কোনো একটি ঘটনায় তাদের কোনো স্বার্থ জড়িত নেই, তাহলে তারা আন্তরিকভাবেই চেঁচামেচি করে। কিন্তু, যদি কোনো আর্থিক সংশ্লেষ বা স্বার্থ থাকে তাহলে তারা নিশ্চুপ থাকে। বিএনপি-জামায়াত যখন শাহরিয়ার কবিরকে দু’বার গ্রেফতার করে তখন অ্যামনেস্টি তাকে ‘কারাবন্দি বিবেক’ ঘোষণা করে।

আসলেই তো তাঁর গ্রেফতার ছিল অত্যন্ত উদ্দেম্যমূলক। কিন্তু ১৯৭১ সালে যখন ৩০ লক্ষ হত্যা বা ৫ লক্ষেরও বেশি নারী যখন ধর্ষিত হয় তখন কি অ্যামনেস্টি সাড়া দিয়েছিল তেমনভাবে? ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে ছাপা একটি ছবি এখনও আমাকে তাড়া করে। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করা হয়েছে মার্কিন যোগসাজশে, আর তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে লাশ দেখানোর জন্য।

যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল হত্যায়। আরো পরে চিলির আইয়েন্দেকেও হত্যা করে সামরিক জুন্তা। সেখানে মানবাধিকার লংঘনে কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে হয়নি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের। কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে দেখলাম সোমালিয়া বংশোদ্ভুত মার্কিন জন প্রতিনিধি ইলহান উমর আর একজন জন প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করছেন, ভেনেজুয়েলা, আল সালভাদরে প্রকাশ্যে মার্কিনীরা সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছে তখন সরকার বলে, গণতন্ত্র রক্ষায় তারা হস্তক্ষেপ করছে, অর্থাৎ মাদুরাকে ভেনুজুয়েলানরা নির্বাচিত করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।

গাজায় গণহত্যা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন? মোটেই না। কারণ, ইসরায়েলিদের রক্ষা করতে হবে। তারা ককেশিয়। তারা আমেরিকা-ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প। মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুর্গ। অর্থাৎ মানবাধিকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে ককেশিয় খ্রিস্টানরা। সেটি পর্যবেক্ষণ করবে ককেশিয় খৃস্টান বা মার্কিনী সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। লাতিন আমেরিকার যে সব দেশ সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পে আসবে না তারাও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিরোধী।

 

‘আগলি আমেরিকান’ শব্দটি আবার ফিরে আসছে। তাদের সৃষ্ট শব্দগুলি এখন মানুষের কাছে হাস্যকর ঠেকেছে। ১৯৭১ এর মতো মার্কিনী ও পাশ্চাত্যের তরুণরা মাঠে নেমেছে এবং অবাক হবো না, যদি তারা বলে বাইডেন ও ট্রাম্পে গণহত্যার ব্যাপারে কোনো তফাৎ নেই, সুতরাং থার্ড পার্টি সৃষ্টি করো।

 

আমেরিকা বা পাশ্চাত্য বা ককেশিয়রা মানবাধিকারের যে সংজ্ঞা বা মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে আমরা সে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি। কারণ, আমাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল যে ককেশিয়রা আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করেছে, তারা এনলাইটেন্ড সমাজ গড়ে তুলছে। এবং তারা নিজেরাও তাই মনে করে। আরো মনে করে এই ‘এনলাইটেনড সমাজ’ বা ‘আলোকিত সমাজ’ রক্ষার দায়িত্ব তাদের। এই বোধ থেকেই তারা জাতিসংঘ নির্মাণ করেছে কিন্তু জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণ যেন চিরদিন তাদের হাতে থাকে সে ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু, তারপরও সব রক্ষা হয় না।

প্যালেস্টাইনে ইসরায়েল যখন গণহত্যা শুরু করেছে তখনই মানবাধিকার প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বজুড়ে। ককেশিয় খৃস্টানরা যে সংজ্ঞা তৈরি করেছে মানবাধিকারের তার ভিত্তিতেই প্রশ্ন ওঠানো হয়েছিল। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এরা মানবাধিকারের সংজ্ঞা নির্ধারণে ধর্মীয় বোধ নিয়ে কাজ করে। আমরা এখানে ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলছি না। শুধু নিরস্ত্র মানুষ হত্যার কথা উঠিয়েছি। মার্কিনি ও পাশ্চাত্য এর প্রতিনিধিরা বলছেন, কই গণহত্যা তো হয় নি। গাজায়তো টেররিস্ট নিধন করা হচ্ছে। আজ পর্যন্ত তারা বলতে পারেনি কতোজন ‘টেররিস্ট’ তারা হত্যা করেছে। কিন্তু, সবাই জানে, তারা ৩৫ হাজার নিরস্ত্র নারী, পুরুষ, শিশু হত্যা করেছে।

যুদ্ধাপরাধের প্রথম প্রমাণ ‘ডিনায়েল’। অর্থাৎ অস্বীকার করা। পাশ্চাত্য, আমেরিকা ও ইসরায়েল গণহত্যা করে তা ‘ডিনাই’ বা ‘অস্বীকার’ করে, তাদের সংজ্ঞায়ই বলতে হচ্ছে তারা ‘গণহত্যাকারী’। আমাদের দুঃখ অন্যখানে। হলোকাস্টকে আমরা ঘৃণা করি, ‘হলোকাস্ট’ মিউজিয়াম দেখে আপ্লুত হয়েছি। আর ইহুদিদের নেতা নেতানিয়াহু প্রমাণ করতে চাচ্ছে ‘হলোকাস্ট’ যৌক্তিক, ন্যায্য। এ দুঃখ কোথায় রাখি!

মার্কিনীদের মানবাধিকার অস্ত্র যখন ছুড়ে দেওয়া হয় তখন প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, সেটি আমাদের সাংবিধানিক বিষয়। কিন্তু যে দেশের ক্ষেত্রে এটি বলা হচ্ছে তাদের সংবিধান এটি স্বীকার করে কিনা সে প্রশ্ন করা যাবে না। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড লু এসেছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে তদন্ত করতে। যে দেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে, যে প্রকাশ্যে বিদেশে হস্তক্ষেপ করছে সে যখন মানবাধিকার নিয়ে চেঁচায় তখন শক্তিহীন আমরা নিশ্চুপ থাকি বটে, কিন্তু, এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, ককেশিয়দের জ্ঞানের ভিত্তি, নৈতিকতার মান যারা ককেশিয় খৃষ্টান নয়, তাদের থেকে কম নয়, এনলাইটেনমেন্টেও তারা পিছিয়ে নয়।

ইসরায়েলি গণহত্যা, হিটলারের গণহত্যাকে বৈধতা দিচ্ছে যা সাড়া বিশে^র জন্য আতংকজনক। কিন্তু, এই গণহত্যা আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, তাহলো পাশ্চাত্য ও আমেরিকা যে শব্দগুলির মূল্যবোধ তৈরি করতে চাচ্ছিল আসলে তা ভাওতাবাজি। তারা এগুলি বিশ্বাস করে না। এসবের কথা বলে তারা এতোদিন বোঝাতে চেয়েছে তারা জ্ঞানী মহাজন, তাদের অনুসরণ করলেই সমাজ সংস্কৃতি রক্ষা পাবে।

এখন তারা প্রমাণ করেছে, তারা এ সব শব্দ সৃষ্টি করেছে তাদের স্বার্থে, যখন দরকার তখন বিশ্বাসের ভান করে, যখন দরকার নেই তখন ভানও করে না। সুতরাং, তাদের সৃষ্ট শব্দের মানদন্ড আমাদের সংস্কৃতি-সমাজের মানদন্ডে বিচার করতে হবে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দেশের হিসাব নিকাশ চাওয়ার অধিকার সৃষ্টি করতে হবে।

১৯৭১ সালে মার্কিনীরা এই একই কাজ করেছিল। সাধারণ মার্কিনী তরুণরা তখন এর প্রতিবাদ করেছে। নিক্সনের পতন হয়েছে। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, গণহত্যার বিচার করার সাহস শেখ হাসিনা (বা আমরা) দেখিয়েছেন দেখে মার্কিন প্রতিনিধিকেও তাদের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পেরেছি [দেখুন প্রথম আলো] লু, তার সহকর্মী হাসের মতো সামন্ত রাজা সুলভ আচরণ করেননি, বিনীত থেকেছেন। তারা এতোটা বোকা নয় যে, বুঝতে পারছেন না, সারা বিশ্ব তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে [কয়েকজন তল্পীবাহক ছাড়া]।

আগলি আমেরিকান শব্দটি আবার ফিরে আসছে। তাদের সৃষ্ট শব্দগুলি এখন মানুষের কাছে হাস্যকর ঠেকেছে। ১৯৭১ এর মতো মার্কিনী ও পাশ্চাত্যের তরুণরা মাঠে নেমেছে এবং অবাক হবো না, যদি তারা বলে বাইডেন ও ট্রাম্পে গণহত্যার ব্যাপারে কোনো তফাৎ নেই, সুতরাং থার্ড পার্টি সৃষ্টি করো। আমাদের শক্তি না থাকুক, কিন্তু আমাদেরও এখন প্রশ্ন তুলতে হবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীর মতো দেশগুলির নৈতিক জ্ঞান নিয়ে, তাদের মানবাধিকার নিয়ে, ককেশিয় খৃষ্টানদের ভন্ডামী নিয়ে।

লেখক: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।