সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে, দুই বাংলায় জয়ার জয়যাত্রা
বাংলাদেশের গর্ব, দুই বাংলার প্রিয়মুখ জয়া আহসান। শুধু সৌন্দর্য কিংবা তারকাখ্যাতি নয়, অভিনয়ের নান্দনিক গভীরতা দিয়েই জয় করেছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। দেশের চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রমাণ করার পর সাহসিকতায় ভর করে পাড়ি জমান প্রতিবেশী দেশ ভারতে। শুরুটা ছিল অনিশ্চয়তায় ঘেরা, কিন্তু নিজের প্রতিভা, পরিশ্রম ও মেধার জোরে সেখানেও গড়ে তুলেছেন শক্ত অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও এখন জয়ার নতুন সিনেমার অপেক্ষায় থাকে ঠিক যেমনটা থাকেন বাংলাদেশিরা। দুই বাংলার সিনেমায় একযোগে সফল এই অভিনেত্রী যেন আজ সীমান্তের ঊর্ধ্বে এক শিল্পিত সেতুবন্ধন-যেখানে রয়েছে সম্মান, ভালোবাসা আর সৃষ্টিশীলতার জয়। ছবি: অভিনেত্রীর ফেসবুক থেকে
-
আজ তার জন্মদিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে ঢাকায় তার জন্ম। অভিনেত্রীর বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা জাহান আরা। পড়াশোনায় বেশ আগ্রহী ছিলেন জয়া, তবে শৈশব থেকেই তার ঝোঁক ছিল শিল্পের দিকে চিত্রাঙ্কন, গান, নাচ ও অভিনয়ে।
-
জয়ার ক্যারিয়ার শুরু হয় মডেলিং দিয়ে, এরপর তিনি নাটকে নিয়মিত হন। নাটকে তার আবেগঘন অভিনয়, সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, কণ্ঠের গাম্ভীর্য-সব কিছু মিলে তাকে এনে দেয় দর্শকপ্রিয়তা।
-
বড় পর্দায় তার যাত্রা হয় ২০০৪ সালে ‘ব্যাচেলর’ ছবির মাধ্যমে। এরপর ‘ডুবসাঁতার’, ‘ফিরে এসো বেহুলা’, ‘গেরিলা’, ‘চোরাবালি’ একে একে তাকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
-
‘গেরিলা’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন সাহসিনী নারীর ভূমিকায় জয়ার অনবদ্য অভিনয় আজও অনেকে মনে রেখেছেন। তিনি শুধু চরিত্র ধারণ করেননি, নিজেকে চরিত্রে বিলীন করে দিয়েছেন। এ ছবির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেন।
-
জয়া যখন প্রথম পশ্চিমবঙ্গের ছবিতে কাজ করার কথা জানান, তখন অনেকে সন্দিহান ছিলেন। বিদেশের মাটিতে একা, ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্য, আর প্রতিযোগিতামূলক ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা-এসবই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ২০১৩ সালে ‘আবর্ত’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে টালিগঞ্জে তার আত্মপ্রকাশ হয়। পরিচালক অরিন্দম শীলের এই ছবিতে জয়ার অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়।
-
এরপর একে একে ‘এক যে ছিল রাজা’, ‘বিসর্জন’, ‘বিজয়া’, ‘কণ্ঠ’, ‘রবিবার’, ‘বিনিসুতো’-প্রতিটি সিনেমায় নিজের প্রতিভার নতুন এক দিক তুলে ধরেন। তার অভিনয়ের পরিণত বোধ, সংলাপ বলার ভঙ্গি, চরিত্রের মধ্যে নিজেকে ভেঙে গড়ার ক্ষমতা-সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দর্শকরা তাকেও ‘নিজেদের অভিনেত্রী’ হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেন।
-
জয়ার টালিউড ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত ছবি নিঃসন্দেহে ‘বিসর্জন’। কৌশিক গাঙ্গুলির পরিচালনায় তৈরি এ ছবিতে বাংলাদেশের এক বিধবা মুসলিম নারী ‘পদ্মা’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি জিতে নেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। পরে ‘বিজয়া’ ছবিতে সেই পদ্মার গল্পের পরিণতি দেখানো হয়।
-
‘বিনিসুতো’ ছবিতে তিনি এক দ্বিধাগ্রস্ত, অব্যক্ত প্রেমে জর্জর এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যেখানে সময় ও বাস্তবতার চাপে সম্পর্ক কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে-তার হৃদয়ভাঙা উপস্থাপন সবাইকে আলোড়িত করে।
-
জয়া আহসান এখন শুধু একজন অভিনেত্রী নন, দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের প্রতীক। তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে অনেক দর্শক প্রথমবার বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গীয় চরিত্রের মেলবন্ধন অনুভব করেন। অনেকেই বলেন জয়ার মধ্যে আছে ‘ঢাকার অনুভব’ আর ‘কলকাতার মেজাজ’-এই দুয়ের এক অপূর্ব মিশেল।
-
পশ্চিমবঙ্গে তিনি যেভাবে নিজের অবস্থান গড়েছেন, তাতে করে ওপারের অনেক নির্মাতা এখন আগ্রহী হন বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্মাতারাও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কাজের আগ্রহ পান, কারণ জয়া প্রমাণ করেছেন দুটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মাঝে চমৎকার সেতু গড়া সম্ভব।
-
জয়া শুধু দুই বাংলায় সীমাবদ্ধ নন। তার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘রবিবার’, ‘দেবী’, ‘বিউটি সার্কাস’সহ অনেক সিনেমা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে। ‘বিসর্জন’ ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার ইস্ট পুরস্কার পান, যা দুই বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে চিনিয়ে দেয়।
-
সাম্প্রতিক সময়ে জয়ার আরও কিছু আন্তর্জাতিক প্রজেক্টের খবর শোনা যাচ্ছে। তার ঝুলিতে যুক্ত হচ্ছে নানা ধাঁচের সিনেমা, নানা ভাষা ও সংস্কৃতির গল্প। এ থেকেই স্পষ্ট, জয়া এখন শুধুই বাংলাদেশের নয়, গ্লোবাল সিনেমার অংশ হতে চলেছেন।
-
জয়া সবসময় মিডিয়ার ঝলমলে জগতে থেকেও ব্যক্তিজীবনকে রাখেন নিয়ন্ত্রিত ও নিভৃত। তার ভাবনা, পোশাকে-আচরণে উঠে আসে সংবেদনশীলতা, দায়িত্বশীলতা ও রুচির ছাপ। তিনি প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল, সামাজিক কাজেও যুক্ত থাকেন। গণমাধ্যমে খুব বেশি কথা না বললেও যখন বলেন, সেটি হয়ে ওঠে বার্তা।
-
জয়া আহসানের এই পথচলা এখনো থেমে নেই। প্রতিবার নতুন কোনো চরিত্রে তিনি যেন নতুন করে জন্মান। দুই বাংলার সিনেমাপ্রেমীরা আজ তার নতুন ছবির জন্য অপেক্ষায় থাকে। নতুন গল্প, নতুন ভাষা, নতুন চ্যালেঞ্জ-সব কিছু নিয়েই জয়ার জয়যাত্রা চলতে থাকে।