ছোট্ট শহর থেকে বিশ্বমঞ্চের কিংবদন্তি মহেন্দ্র সিং ধোনি
রাঁচির এক নিঃশব্দ গলিতে বেড়ে ওঠা এক ছেলে, কে জানতো একদিন বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে উঠবে? ‘মহেন্দ্র সিং ধোনি’ নামটি শুধু একটি পরিচয় নয়, এক আস্থার প্রতীক। ক্রিকেট মাঠে ঠান্ডা মাথার অধিনায়ক, ম্যাচ ফিনিশ করার দুর্দান্ত ক্ষমতা আর নীরব নেতৃত্বের এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি। সাফল্যের শীর্ষে থেকেও যিনি পায়ের নিচে মাটির টান ভুলে যাননি কখনো। মধ্যবিত্ত জীবনের সংগ্রাম আর সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন সময়ের কিংবদন্তি। ধোনির গল্প আসলে সাহস, স্বপ্ন আর সংযমের এক দুর্লভ পাঠ। ছবি: ফেসবুক থেকে
-
১৯৮১ সালের এই দিনে ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে তার জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার দিকেই তার মন বেশি ছিল। তবে প্রথমে কিন্তু ক্রিকেট নয়, ধোনি ছিলেন স্কুল ফুটবল দলের গোলরক্ষক। পরবর্তীতে এক কোচের অনুরোধে উইকেটকিপিং শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ক্রিকেট হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান।
-
তার বাবা পাণ সিং ধোনি ছিলেন চাকরিজীবী, পরিবারে মধ্যবিত্ত জীবনের সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে স্বপ্নে কোনো ছাঁক ছিল না। ক্রিকেট খেলার জন্য বিভিন্ন ছোট টুর্নামেন্টে ট্রেনে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সফর করতেন ধোনি, রাত কাটাতেন স্টেশনে। জীবনের সেই সংগ্রামী অধ্যায় তাকে গড়ে তোলে এক অনমনীয় ব্যক্তিত্বে।
-
ক্রিকেটের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য ভারতীয় রেলে টিকিট চেকার হিসেবে কাজ শুরু করেন ধোনি। খড়গপুর স্টেশনে টিকিট কাটতে কাটতে তার হাতেই ধরা ছিল ভবিষ্যতের কল্পনাতীত কাহিনি।
-
২০০৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটলেও সেই ম্যাচে তিনি শূন্য রানে আউট হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪৮ রানের ঝড়ো ইনিংস তাকে রাতারাতি পরিচিত করে তোলে।
-
এরপর শুরু হয় মহাকাব্যিক এক যাত্রা। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়, ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়।
-
একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির তিনটি বড় ট্রফি জয়ের কৃতিত্ব আজও শুধুই ধোনির ঝুলিতে।
-
ধোনি মানেই ঠান্ডা মাথা। চাপের মুখে হাসিমুখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অসাধারণ ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছেন, তা তাকে দিয়েছে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ খেতাব। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গম্ভীর, কোহলি কিংবা যুবরাজদের ওপর ভরসা করা, তরুণদের সুযোগ দেওয়া-সবকিছুতেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক অধিনায়ক।
-
তিনি কখনো ক্যামেরার সামনে নিজেকে বড় করে দেখাতে চাননি। দলের জয়েই ছিল তার আনন্দ এবং পরাজয়ে নিজের কাঁধে নিয়েছেন সমস্ত দায়।
-
সাফল্য এসেছে নীরবে, গ্ল্যামার থেকে দূরে থেকেও কীভাবে একজন মানুষ কিংবদন্তি হতে পারে ধোনি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
-
ম্যাচের শেষদিকে যখন সবার হাত-পা কাঁপে, তখন দৃঢ়তা আর স্থিরতা নিয়ে যিনি ক্রিজে থাকতেন, তিনি এমএস ধোনি। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘ফিনিশার’ হিসেবে তিনি পরিচিত।
-
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেটের পেছনেও ছিলেন অতুলনীয়। স্ট্যাম্পিংয়ের গতি, রিফ্লেক্স এবং অ্যান্টিসিপেশন-সব কিছু মিলিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা কিপার হিসেবে স্বীকৃত।
-
২০২৫ সালের আইপিএলে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের প্রথম উইকেটরক্ষক যিনি ২০০ এর বেশি ডিসমিসাল করেছেন। এখনো তার ফিটনেস, মুভমেন্ট, আর মাঠের উপস্থিতি দেখে অভিভূত হন তরুণরাও।
-
ক্রিকেটার হিসেবে ধোনি যত বড়, মানুষ হিসেবেও ঠিক ততটাই বিনয়ী। নিজ শহর রাঁচিতে এখনো তিনি সময় কাটান পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে। জন্মদিনে জাঁকজমকপূর্ণ পার্টির বদলে বন্ধুমহলে ঘরোয়া কেক কাটা, প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো কিংবা বন্ধুর জন্মদিনে চুপিচুপি উপস্থিত হওয়া এসবই তার হৃদয়ের গভীরতা প্রকাশ করে।
-
তিনি কখনো বিতর্কে জড়ান না, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও থাকেন সংযত। স্ত্রী সাক্ষী এবং মেয়ে জিভাকে নিয়ে তার পারিবারিক জীবন যেন এক শান্তির আবাস।
-
ধোনির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হয়তো ট্রফি নয়, মানুষের হৃদয় জয়। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, একজন শিক্ষকও। তরুণরা বলেন, ধোনির কাছ থেকে শিখেছেন কীভাবে জেতার পর মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, হারার পর মাথা নিচু না করে সামনে এগোতে হয়।