জন্মদিনে জানুন মেসির বিশ্বজয়ের গল্প
ফুটবল ইতিহাসে এমন কিছু নাম থাকে, যাদের গল্প শুধু খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়; তা হয়ে ওঠে প্রেরণার উৎস, স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। লিওনেল মেসি ঠিক তেমনই এক নাম। ১৯৮৭ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্ম নেওয়া এই জাদুকর আজ কেবল মাঠের নয়, কোটি মানুষের হৃদয়ের অধিপতি। শৈশবের রোগ-শোক, হাজারো প্রশ্ন আর সমালোচনার বেড়াজাল পেরিয়ে মেসি অবশেষে পৌঁছেছেন ফুটবলের সর্বোচ্চ শিখরে। বিশ্বকাপ হাতে তোলা সেই মুহূর্ত শুধু একটি দেশের নয়, ছিল সারা বিশ্বের আবেগের বিস্ফোরণ। চলুন জন্মদিনে জেনে নেই-কীভাবে এক ক্ষুদে ছেলে হয়ে উঠলেন বিশ্বজয়ের কিংবদন্তি। ছবি: ফেসবুক থেকে
-
মেসির মাত্র ১১ বছর বয়সে ধরা পড়ে হরমোন জনিত সমস্যা, যার ফলে স্বাভাবিকভাবে উচ্চতা বাড়ছিল না। চিকিৎসার খরচ বহন করার মতো সামর্থ্য ছিল না মেসির পরিবারে। আর্জেন্টিনার বড় বড় ক্লাবগুলো তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, কেউই সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি।
-
কিন্তু তখনই আশার আলো হয়ে এল স্প্যানিশ ক্লাব এফসি বার্সেলোনা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে এক প্র্যাকটিস সেশনে চোখধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে কোচদের মুগ্ধ করেন তিনি। এরপর ক্লাব তাকে স্পেনে নিয়ে আসে এবং পুরো চিকিৎসার ভার নেয়। সেখান থেকেই শুরু হয় লিওনেল মেসির কিংবদন্তি হয়ে ওঠার যাত্রা।
-
২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার মূল দলে অভিষেক হয় মেসির। এরপর প্রায় দুই দশক ধরে ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন ৭৮০টির বেশি ম্যাচ, করেছেন রেকর্ড ৬৭২ গোল। তার নেতৃত্বে বার্সেলোনা জিতেছে ১০টি লা লিগা শিরোপা, ৭টি কোপা দেল রে, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ট্রফি।
-
মেসির খেলার ধরন ছিল চোখে জল আনা শিল্প। পাস, ড্রিবল, শট-সবকিছুতেই ছিল পরিপূর্ণতা। তার পায়ে বল মানেই যেন সংগীতের মতো এক ছন্দ।
-
বার্সেলোনায় সাফল্যের ফুলঝুরি ঝরালেও আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে বারবার ব্যর্থতার গ্লানি পিছু নিয়েছিল মেসিকে।
-
২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে হেরে যাওয়ার বেদনা, কোপা আমেরিকায় একাধিকবার রানার্স আপ হয়ে যাওয়ার হতাশা-সব মিলিয়ে জাতীয় দলের হয়ে কিছু করতে না পারার গ্লানি মেসিকে ভেতরে ভেতরে কুরে খাচ্ছিল।
-
এক সময় জাতীয় দল থেকে অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আবার ফিরে আসেন, আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে।
-
২০২১ সালের কোপা আমেরিকা মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এক নতুন মোড়। ব্রাজিলের মাটিতে ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে আর্জেন্টিনাকে এনে দেন বহু কাঙ্ক্ষিত শিরোপা। সেই জয় শুধু একটি ট্রফি নয়, মেসির প্রতি বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা অবমূল্যায়নের জবাব।
-
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে অধ্যায়।
-
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে পরাজয়। কিন্তু এরপর একে একে সব বাধা জয় করে আর্জেন্টিনা পৌঁছে যায় ফাইনালে।
-
ফ্রান্সের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর সেই ফাইনালে দুইবার এগিয়ে গিয়েও টাইব্রেকারে গড়ায় খেলা। স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ে অবশেষে বিজয়ী আর্জেন্টিনা। আর সেই সঙ্গে মেসির হাতে উঠলো ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার ট্রফি ফিফা বিশ্বকাপ।
-
মেসির চোখে জল, গোটা দল তাকে ঘিরে নাচছে। আর্জেন্টিনা জুড়ে উল্লাস, বিশ্ব জুড়ে আবেগ। একটা মানুষ, যিনি শুধু ফুটবল খেলেন না মানুষকে স্বপ্ন দেখান। তার জয়ের আনন্দ একক নয়, তা ছিল বিশ্ববাসীর।
-
মেসির মাঠের বাইরের জীবনও অনুকরণীয়। কখনো অহংকারে ভেজেননি। স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জোকে বাল্যবন্ধু হিসেবে পাওয়া, সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানো, সাদামাটা জীবনযাপন-মেসি যেন আধুনিক দুনিয়ার মধ্যে একজন অনাড়ম্বর নায়ক। সাফল্য তাকে আচ্ছন্ন করেনি, বরং করে তুলেছে আরও সংবেদনশীল।
-
কেউ বলে মেসি পেলের চেয়েও বড়; কেউ বলে মারাদোনার উত্তরসূরি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেসি শুধুই মেসি। নিজস্ব ধারায়, নিজস্ব ছন্দে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য সাম্রাজ্য। এমনকি যারা ফুটবল বোঝেন না, তারাও তাকে ভালোবাসেন শুধু তার সততা ও শুদ্ধতার জন্য।