হালুম…
এশিয়া কাপের মোড়কে আসলে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের জন্য চলছে টাইগারদের তর্জন-গর্জন। এশিয়ার ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম দুই পরাশক্তি শ্রীলংকা-পাকিস্তান সে ঝাঁজ বুঝেছে হাড়ে হাড়ে। ভারতকে তা বোঝানো খানিকটা শক্ত হলেও অসম্ভব যে নয়, তা বোঝার জন্য অনন্ত জলিলীয় অভিজ্ঞতা থাকার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই রজনীকান্তীয় হালচালেরও। এই এশিয়া কাপেই বাংলাদেশের দাপটের দিকে খানিকটা চোখমেলে তাকালেই বোঝা যায়।
ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে বাংলাদেশ ১ রানে জিতুক বা ১০০ রানে বা ১০ উইকেটে, বিষয়টা মোটেই যে সহজ নয়, সেটাও কিন্তু কোনো ‘রকেট সায়েন্স’ না। তবে তাবৎ ক্রিকেট দুনিয়ায় ‘মোড়ল’ বলে পরিচিত এই ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জয় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রয়োজন কেবল নিজেদের স্বীকৃতির জন্যেই নয়, বরং নিজেদের উত্থানের বার্তা ঠিক ঠিক জায়গা মতো পৌঁছানোর জন্যও।
পাকিস্তানকে হারিয়ে রমিজ রাজাকে যেমন তার কৃতকর্মের জবাব দেয়া গেছে ভারতের নভোজিত সিং সিধুকেও একই রকম জবাব দেয়ার সুযোগ কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে আসে না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয় বৈ কি। আর সুযোগ পেয়ে একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে আফসোসও হয়তো করতে হতে পারে।
আফসোসের কথা উঠতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চারপাশটা চলে গেল চার বছর আগের এক মার্চে, সেই শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামেই। সেবার মাত্র দুই রানে হারতে হয়েছিল সাকিবদের। এত কাছে তবু এত দূর- লালকালিতে লেখা এই শিরোনামের নিচে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিকে সাকিবের ঠোঁটে হাত রেখে কান্নার ছবি দেখে কেঁদেছিল গোটা বাংলাদেশই।
সেই মাশরাফি, সেই মুশফিক, সেই সাকিব, সেই মাহমুদুল্লাহ থাকলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন বদলে গেছে অনেক। দাপুটে জয়ে ভারতবধ এখন শুধু প্রত্যাশাই নয়, রীতিমতো সম্ভাবনা। হতে পারে অপেক্ষাও।
এশিয়া কাপের চলতি আসরে বাংলাদেশ-ভারতের পারফরমেন্সে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৪৫ রানে পরাজিত হলেও নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ আরব আমিরাতের বিপক্ষে বাংলাদেশের আসে ৫১ রানের জয়। আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের ম্যাচ দুটির ফলাফল খুব সহজ সমীকরণে বাংলাদেশের পক্ষে এনে ফেলা যায় এভাবে- ১৭.৪ ওভারে বাংলাদেশ আমিরাতকে অলআউট করে দিলেও ভারতের বিপক্ষে ২০ ওভারই ব্যাট করেছে আমিরাত। ম্যাচ শেষের ফলাফল- দুই দুলই জয় পেয়েছে আমিরাতের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ও ভারত-শ্রীলঙ্কার ম্যাচের দিকে তাকালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পুরো ২০ ওভার খেলে সাত উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ১৪৭ রান। শ্রীলঙ্কা জবাবে পুরো ওভার খেলে আট উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ১২৪ রান। বাংলাদেশ ম্যাচ জেতে ২৩ রানে। ভারত-শ্রীলঙ্কার ম্যাচে প্রথম ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ১৩৮ রান। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে যা সংগ্রহ ছিল তার চেয়ে ১৪ রান বেশি। যার অর্থ দাঁড়ালো- বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে যে রানে বাধতে পেরেছিল ভারত শ্রীলঙ্কাকে রুখতে পেরেছে তার চেয়ে ১৪ রান বেশিতে; এগিয়ে থাকলো বাংলাদেশ। অবশ্য ভারত ওই ম্যাচে ৫ উইকেটে জিতেছিল। 
ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের দিকে তাকালে দেখা যায়, পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ রান তুলেছে প্রতি ওভারে গড়ে ৬ দশমিক ৮৫ করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ভারত রান তুলেছে প্রতি ওভারে গড়ে ৫ দশমিক ৫৫ করে। ২০ ওভারের খেলার হিসেবে এখানেও ধরা যেতে পারে বাংলাদেশ ২৬ রানে এগিয়ে।
এছাড়াও এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি পাওনা হিসেবে রয়েছে- কোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথমবারের মতো কোনো দলকে অলআউট করে দেয়া (আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে) ও টি-টোয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম জয়। এমন নানা সমীকরণ মাথায় নিয়ে ভারতের বিপক্ষে একটি জয়ের জন্য অপেক্ষা করা যেতেই পারে আর জয়ী হওয়া যদি সম্ভব নাও হয় তবে পরাজয়টাকে একটা অঘটন হিসেবেই মনে করা যেতে পারে।
সবকিছুর পরেও জয়-পরাজয় যাই আসুক সেটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আবেগের বশে এমন কিছু করে না ফেলাই ভালো, যা প্রকৃতপক্ষে ভালো না। যেমন পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর মাঠে এক পাকিস্তানি সমর্থককে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছিল। অবশ্য অভিযোগটি যে সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। এরআগে মিরপুরের এই স্টেডিয়ামেই ভারতীয় এক সমর্থককেও হেনস্তার অভিযোগ উঠেছিল। মনে রাখতে হবে, এসব হেনস্তার অভিযোগে আসলে বাংলাদেশের মাথা হেঁটই হয়, আর কিছু হয় না। আর যেহেতু দেখা যাচ্ছে কোনো না কোনোভাবে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সুতরাং এটা স্পষ্ট যে কেউ তো আছেন, যিনি ঠাণ্ডা মাথায় চক্রান্ত করছেন। অর্থাৎ `দুষ্ট গরু`র থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।
বুকে বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন নিয়ে যখন এই লেখাটি লিখছি, চোখে তখন রামপুরায় নিহত দুই শিশুর ছবি। শোনা যাচ্ছে, শিশু দুটির মা-ই নাকি তাদের হত্যা করেছে। তাও আবার তাদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই। বাংলাদেশ-ভারত যখন ফাইনালে মুখোমুখি হবে, বেঁচে থাকলে হয়তো এই শিশু দুটিও বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলা দেখতে মিরপুর যেত বা টিভির সামনে বসে মাশরাফিদের সফলতায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতো। ওদের নীরব চলে যাওয়া সমাজ ঠেকাতে পারেনি; কিন্তু বার বার সমাজ যেন ব্যর্থ না হয় সে দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।
এনএফ/আইএইচএস/আরআইপি