‘আমার মতো পার্বতীদের পূজা নেই’

পিকলু চক্রবর্তী
পিকলু চক্রবর্তী পিকলু চক্রবর্তী , কবি, লেখক ও সংবাদকর্মী, আমিরাত
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২১

অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে, নাম তার পার্বতী। মা, বাবা, ভাইকে নিয়েই পার্বতীদের সংসার! পার্বতীর বড় ভাই প্রকাশ একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন। পার্বতী শহরে একটা দর্জির দোকানে চাকরি করে। টানাটানির সংসার তার মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য যুদ্ধ! তবুও যে অন্ত নেই তাদের নতুন নতুন স্বপ্নের! স্বপ্নই বুঝি মানুষের বেঁচের থাকার চাবিকাঠি।

নতুন আরেক সদস্যের আগমনের সিঁড়িতে পা রাখলো পার্বতীর পরিবার। পার্বতীর ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো, তবে সংসারের ক্ষেত্রে পার্বতীর বড় ভাই খুব উদাসীন! এদিকে পার্বতীরও বিয়ের বয়স হয়েছে, তাতে কী বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, প্রত্যেকটি পরিবারের মেয়েরা চায় তাদের বড় ভাইদের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে তাদের বিয়ে হোক। ‘পুরুষ বা নারী যেই হোক বিয়ে ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তি ইচ্ছা স্বাধীন থাকা উচিত’।

অবশেষে সব জল্পনা কল্পনা ও দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করে পার্বতীদের পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন হলো। নতুন বউ, নতুন সংসার, তার সঙ্গে বদলাতে থাকে পরিবারের প্রাণবন্ততা! যদিও পার্বতী ও তার মা বাবা মেনে নিচ্ছিলেন অনেক কিছুই, কারণ তারা হয়তো বুঝতেন পৃথিবীতে সব থেকে বড় লড়াই, সংসার লড়াই! এই লড়াইয়ে ধ্বংসটাই বেশি থাকে। তবুও যে দিনশেষে টিকে থাকার লড়াই করে যেতে হয়!

চলছে জীবন, চলছে যুদ্ধ, চলছে সংসার, তার মধ্যেই এলো দুর্গাপূজার আমেজ। কত আয়োজন, কত প্রয়োজন, কত স্বাদ-আহ্লাদ, চারদিকে পূজার কেনাকাটার ধূম কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু পার্বতীর পরিবারের পূজার আমেজটা কেমন?

পার্বতীর বড় ভাই ও ভাইয়ের বউ মিলে শহরের বড় শপিংমলে গেলেন পূজার শপিং করতে। প্রকাশ তার বউয়ের জন্য প্রায় ১৫ হাজার টাকার শপিং করলেন। অথচ প্রকাশের মাসিক আয় ১২ হাজার টাকা। এদিকে বাড়িতে বৃদ্ধা মা-বাবা ও ছোট বোন পার্বতীর কথা তারা একবারও ভাবলেন না। শপিং শেষে তারা বাড়ি ফিরলেন। শপিংয়ের বিষয় নিয়ে মা বাবার কাছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কিচ্ছা শুনিয়ে প্রকাশ ও তার বউ নিজ রুমে গেলেন!

মা-বাবা বলে কথা, অধিকাংশ মা-বাবা আমৃত্যু ছেলে-মেয়েদের সুখের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। প্রকাশ ও তার বউ যতটুকু সহজে তাদের বোকা বানিয়ে নিজেদের খুব বু্দ্ধিমান ভাবছেন তবে মোদ্দা কথা হলো মা-বাবারা বোঝেন না কী সেটাই ভাবা উচিত ছিল! বিষয়টা এমন ছিল যে মায়ের কাছে এসে মামার বাড়ির গল্প বলা হচ্ছে।

এদিকে, সারা দিনের ক্লান্তি শেষে যখন পার্বতী বাড়ি ফিরলো তখন সে দেখলো রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক নাটক। মুখ তুবড়ে নীরবে সবকিছু হজম করে নিলো পার্বতী। মনে মনে ভাবলো আজ পঞ্চমী, কাল ষষ্টী আর যাই হোক পূজায় মা-বাবাকে নতুন কাপড় পরাতেই হবে।

পরদিন পার্বতী দর্জির মালিক’কে বললো দাদা আমাকে এবার এক মাসের বেতন অগ্রীম দিতে হবে। মহাজন জানতে চাইলেন কেন? পার্বতী বললো বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা খুব অসুস্থ। আপনাকেও বলছি না দোকানে কাজের চাপ বেশি। আজ দোকানে আসার পথে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম প্রায় তিন হাজার টাকার উপরে ওষুধ কিনতে হবে।

যদি সুস্থ না থাকি তা হলে কাজ করবো কী করে দাদা। দয়া করে আমাকে এ মাসের বেতনের সঙ্গে অগ্রীম আরেক মাসের বেতন দেন। আমি তো আপনার এখানেই কাজ করছি। অবশেষে দর্জির মহাজন টাকা দিলেন।

সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফেরার সময় শপিংমলে গেলো পার্বতী। মায়ের জন্য একটা শাড়ি, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, ভাইয়ের জন্য একটা শার্ট, বউদির জন্য একটা শাড়ি, অবশিষ্ট পার্বতীর হাতে মাত্র ৫০ টাকা। শহর থেকে বাড়ি ফিরতে বাস ভাড়া ৪০ টাকা। সারাদিনের পরিশ্রম ক্লান্তিময় শরীর কতশত ইচ্ছাকে ফানুস করে ঘরে ফিরলো পার্বতী।

হাসিমাখা মুখ কত উল্লাস মা, বাবা, দাদা, বউদি এদিকে এসো পূজায় চারদিনের ছুটি পেয়েছি সঙ্গে বোনাসও পেয়েছি। সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় এনেছি। কাল ষষ্ঠ আমরা সবাই নতুন জামা-কাপড় পরে মণ্ডপে যাবো। সবাইকে সবার জামা-কাপড় বুঝিয়ে দিলো পার্বতী। হঠাৎ মা-বাবা পার্বতীকে প্রশ্ন করলেন কিরে পার্বতী তোর নতুন শাড়ি কোথায়?

পার্বতী খুব রাগি ভাব দেখিয়ে বললো আর বলো না শাড়ি থেকে ব্লাউজ পিস কেটে ব্লাউজ বানানোর জন্য সুবোধ দার দোকানে দিয়ে এসেছি। কাল বিকেলে দেবেন। আমাদের দোকানেও কাজের খুব চাপ। বাবা কিছুদিন আগে আমার জন্য যে জামাটা কিনে এনেছিলেন ষষ্ঠীতে সেটা পরবো এবং তোমাদের নিয়ে বের হবো। প্রথমে বাবার দেওয়া উপহারটা গায়ে লাগিয়ে মণ্ডপে যেতে আমারও খুব ইচ্ছে তাই সুবোধ দাকে আর তেমন তাড়াহুড়ো করতে বলিনি।

আজ ষষ্ঠী, পার্বতী ও তার পুরো পরিবার মিলে শহরে মণ্ডপ দেখতে বের হলেন। শহরে খুব বড় একটি পূজার মণ্ডপ আছে, যেখানে খুব জাঁকজমকভাবে পূজা হয় সেখানে গেলো তারা। সবাই দুর্গা মাকে প্রণাম করছেন, মনে মনে কত কিছু আশা করছেন, প্রসাদ খাচ্ছেন, আরতি দেখছেন, হই হুল্লোড় করছেন, ছবি তুলছেন, কত রকমের আমোদ ফূর্তি হচ্ছে!

পার্বতী দাঁড়িয়ে দেখছে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চোখের জলে এখনই বন্যা হয়ে যাবে ভেতরে আর্তনাদে সব ডাকঢোল বন্ধ হয়ে যাবে। পূজা মণ্ডপটা একটা পতিত জমিতে রূপ নেবে। হঠাৎ পার্বতীর মা এসে বললেন, কিরে তুই এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছিস, যা মাকে প্রণাম করে আয়, আরও কত মণ্ডপ দেখার বাকি রয়েছে!

পার্বতী মণ্ডপের সামনে গিয়ে দুর্গা মাকে প্রমাণ করে মনে মনে বললো মা’গো আমার মতো পার্বতীদের কোনো পূজা নেই, কোনো আয়োজন নেই, কোনো প্রয়োজন নেই, আছে শুধু বেঁচে থাকার লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস। বিশ্বাস করো প্রতিমা আমার দুর্গা রক্তে মাংসে গড়া আমার ‘মা’ ভালো থাকো প্রতিমা। প্রণাম শেষে প্রণামী বক্সে পার্বতীর অবশিষ্ট ১০ টাকা দিয়ে এলো।

তারপর বাবাকে বললো বাবা শরীরটা ভালো বোধ করছি না! আমাকে ১০০ টাকা দাও আমি বাড়ি ফিরে যাই তোমরা মণ্ডপ দেখে ঘুরে আসো। বাবার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পার্বতী। পূজামণ্ডপ থেকে তিন মাইল জায়গা হেঁটে সেখান থেকে ৯০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরলো পার্বতী।

দিনশেষে এভাবেই পার্বতীরা অদৃশ্য লীলাখেলাকে মুখ বুঝে সয়ে যায়। এভাবেই অধিকাংশ পার্বতীরা অনেক আমোদ, প্রমোদ, জল্পনা, কল্পনা, অনলশিখায় পুড়িয়ে এগিয়ে যায় নিজ সত্তায়। পার্বতীদের মতো রক্তে মাংসে সাহসে বুদ্ধিতে শত শত স্বয়ং দুর্গার আবির্ভাব হোক।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]