মানুষ বনাম বেওয়ারিশ কুকুর; দ্বৈতমানদণ্ডের নগ্ন সত্য

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫
আবুল কালাম আজাদ

আবুল কালাম আজাদ

সম্প্রতি কুকুর ছানা পানিতে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনায় এক নারীর জামিন না-মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ বলছেন এটি অমানবিকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, আবার কেউ বলছেন এটি নির্বাচিত ন্যায়বিচারের আরেকটি উদাহরণ। কিন্তু যাই বলা হোক, ঘটনাটি আমাদের সমাজব্যবস্থা, আইনের প্রয়োগ, মানবিকতা এবং বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার একটি নগ্ন প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের নগর ও উপনগর এলাকাগুলোতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি মিলিয়ে প্রতিটি রাস্তাঘাট-অলি-গলি-যেখানেই চোখ যায় সেখানেই ছোট-বড় মিলিয়ে দলবদ্ধ কুকুর দেখা যায়। অনেক সময় এগুলো পথচারীকে তাড়া করে, কামড়ে দেয়, কিছু ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক আচরণ করে।

নানা পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে-কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমনকি ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপর ভয়াবহ হামলার ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু তবুও এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান, জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পুনর্বাসন-কোনো কিছুরই ধারাবাহিক ও সরকারি বেসরকারি কার্যকর উদ্যোগ নেই।

অন্যদিকে, এই পশুগুলোও রাস্তায় পড়ে থাকা খাবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। শীতের সময় ক্ষুধা, ঠান্ডা ও আশ্রয়ের সংকটে তারা আরও দুর্বল ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। মানুষ তাদের মারধর করে, লাথি মারে, পাথর ছোড়ে-মানুষের নিষ্ঠুরতা ও বেওয়ারিশ কুকুরের হিংস্রতা যেন একে অপরকে আরও উসকে দেয়। এই দ্বন্দ্বে ভোগে মানুষও, ভোগে প্রাণীগুলোও। অথচ এই সমস্যার সমাধান কখনোই ব্যক্তিপর্যায়ের নয়; এটি নিঃসন্দেহে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

এই প্রেক্ষাপটে ডুবিয়ে কুকুর ছানা হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া নারী ঘটনা পুরো সমস্যাটিকে নতুনভাবে সামনে আনে। অভিযোগ, তিনি নাকি কুকুর ছানাগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলেছেন। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীকে এমনভাবে প্রচার করা হলো যেন তিনি কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধী। জামিনও পেলেন না। তাকে ঘিরে এক ধরনের জনরোষ সৃষ্টি হলো। কেউ বিচার চাইলেন, কেউ নিন্দা করলেন, কেউ আবার বললেন-এটি ভয়ঙ্কর পশু নির্যাতন, এজন্য কঠোর শাস্তি হওয়াই উচিত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো-এটা কি সত্যিই এমন এক অপরাধ, যার জন্য একজন নারীকে জামিন না দিয়ে তার ছোট্র শিশুসহ জেলে পাঠাতে হবে? বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা জানেন এ বিষয়ে সঠিক রায় কী হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ‘কোন অপরাধে জামিন হয়’ আর ‘কোন অপরাধে হয় না’-এর কোনো সুসংগত নীতি নেই। ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ-এমনকি হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধেও বহু আসামি সহজেই জামিন পেয়ে যায়। কিন্তু কুকুর ছানা হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত একজন নারীর জামিন নাই! এটি যথার্থ বিচার নয়, এটি বিচারের নামে এক ধরনের প্রদর্শনী।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার-মিডিয়া এই নারীর পরিচয়, ছবি, সবকিছু এমনভাবে প্রকাশ করল যে তার সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত মর্যাদা, ভবিষ্যৎ-সবকিছু মুহূর্তেই ভেঙে পড়ল। একজন নারীকে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য সমাজ কতটা ক্ষুধার্ত সেটা এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হলো। অথচ তার পক্ষের বক্তব্যও ছিল-ছানা কুকুরগুলো নাকি তার ছোট বাচ্চার জন্য হুমকি হয়ে উঠছিল, তাই তিনি এগুলো দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য দুধওয়ালার হাতে বস্তা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এর সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ কি কেউ পেল? কেউ কি চেষ্টা করল? নাকি সমাজ ও মিডিয়া একসঙ্গে মিলে একটি ‘খলচরিত্র’ তৈরি করার উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে গেল?

এই ঘটনার বিপরীতে আমরা স্মরণ করি সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধন অভিযানের কথা-যারা গলায় ফাঁস দিয়ে, ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিনের পর দিন হাজার হাজার কুকুর হত্যা করেছে। মানবিক সংস্থাগুলো, প্রাণী অধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ করেছেন, আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু কোনোদিন শুনিনি কোনো কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন, বা আদালত তাদের জামিন না-মঞ্জুর করেছেন। রাষ্ট্র যখন হত্যা করে-তখন সেটা নাকি ‘সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’; আর কোনো সাধারণ নাগরিক ভুল-সঠিক যাই হোক একটা কাজ করলে-সেটা হয়ে যায় ‘অপরাধ’? এই দ্বৈতমানদণ্ড কি ন্যায়বিচারের ব্যাখ্যা দেয়?

বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার যদি ১৯৮০–৯০ দশকের নিষ্ঠুর কুকুর হত্যার নীতি পরিত্যাগ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই সেটা প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো-তার বিকল্প নীতি কী? নিউটার করা হচ্ছে কি? টিকা দেওয়া হচ্ছে কি? আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে কি? রাস্তার কুকুরগুলোকে নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তর করা হচ্ছে কি? কোনো কার্যকর, দীর্ঘমেয়াদি, পরিকল্পিত উদ্যোগ কি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য-উত্তর হলো ‌‘না’।

বাংলাদেশে বেওয়ারিশ কুকুর সমস্যা একটি জনস্বাস্থ্য সংকট, একটি নিরাপত্তা সংকট এবং একটি মানবিক সংকট-সব মিলেই এক বিশাল সমস্যা। রাষ্ট্র যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, তাহলে কুকুরের সংখ্যা যেমন বাড়তেই থাকবে, আক্রমণও বাড়বে, জনস্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে। এতে ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ-বিশেষত শিশু ও নারী। অনেক সময় দেখা যায় ভোরবেলায়, গভীর রাতে বা নির্জন রাস্তায় মানুষ একা চলতে ভয় পায়, কারণ দলবদ্ধ কুকুর তাদের ঘিরে ধরে।

তাহলে কি কুকুরগুলোকে হত্যা করাই সমাধান? অবশ্যই নয়। কিন্তু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? বিশ্বের বহু দেশ-ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, তুরস্ক-জন্মনিয়ন্ত্রণ, টিকাদান, পুনর্বাসন এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। বাংলাদেশ কেন পারছে না? সমস্যাটি দক্ষতা নয়, সমস্যাটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। বেওয়ারিশ কুকুরের সমস্যা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায়ই নেই। ফলে মানুষও অসহায়, কুকুরও অসহায়। সমস্যা অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় প্রতিদিনই ভয়াবহ হতে থাকে।

এদিকে কনকনে শীত সামনে। শীতে কুকুরগুলো আরও দুর্বল, আরও ক্ষুধার্ত, আরও অসহায় হয়ে পড়ে। এদের খাদ্যাভাব বাড়ে, ঠান্ডায় অনেক কুকুর মারা যায়। কোনো শহর-পরিকল্পনা নেই যে কোথায় তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে, কোথায় গরমের ব্যবস্থা থাকবে, কোথায় চিকিৎসা হবে। প্রাণীগুলো রাস্তার পাশে, ডাস্টবিনের কোণে, নোংরা নর্দমার ভেতরে দিন কাটায়। এ অবস্থায় মানুষ যদি একটু খাবার দেয়-তাদের ওপর দোষারোপ করা হয়; না দিলে কুকুরগুলো আরও আক্রমণাত্মক হয়। সবমিলিয়ে একটি বিশৃঙ্খল, অমানবিক চক্র তৈরি হয়েছে।

সুতরাং, ওই মহিলার শাস্তি হোক-যদি তিনি সত্যিই অপরাধ করে থাকেন। আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত এবং কোনো প্রাণীকে অমানবিকভাবে হত্যা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে দেওয়া যাবে না। কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ, টিকাদান, আশ্রয় কেন্দ্র, উদ্ধার টিম, জরুরি হেল্পলাইন-এসব কার্যকর না হলে কোনোদিনই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এভাবে কুকুরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় মানুষের জন্য বড় ধরনের হুমকিতে পরিণত হতে পারে।

আমার এই কলামের সারকথা একটাই-ন্যায়বিচার নির্বাচিতভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। একজন সাধারণ নারীর জন্য কঠোর শাস্তি, আর সরকারের নিজস্ব দায়িত্বে কুকুর হত্যায় শূন্য জবাবদিহি-এটি কোনো সভ্য দেশের পরিচয় নয়। যে কোনো বিচার হতে হবে যুক্তিগ্রাহ্য, মানবিক এবং নীতিসম্মত।

আমরা চাই আইন হোক ন্যায়সঙ্গত। আমরা চাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হোক। আমরা চাই প্রাণীদেরও মানবিক আচরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হোক। এবং সবচেয়ে বড় কথা-আমরা চাই রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করুক।

কারণ বেওয়ারিশ কুকুরের চেয়ে বড় সমস্যা এই দেশে প্রচুর আছে, কিন্তু যেটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে-এটি জননিরাপত্তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই সমস্যা নিয়ে সরকারের জরুরি, বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এখন সময়েরই দাবি। না হলে শিগগিরই কোনো একদিন হয়তো আবার কোনো শিশুকে কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়ার খবর পত্রিকার শিরোনাম হবে, আর আমরা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবো- ‌‘এটা তো হতেই পারত না।’

এখন সময় হচ্ছে মানুষের নিরাপত্তা, কুকুরের কল্যাণ-দুটিকেই সমান্তরালভাবে বিবেচনায় এনে একটি টেকসই সমাধান গড়ে তোলার। অন্যথায় এই সমস্যার ভয়াবহতা আরও বাড়বে এবং সমাজ প্রতিদিন আরও নৃশংস হয়ে উঠবে-মানুষের প্রতিও, প্রাণীর প্রতিও। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়-আমরা কি মানবিক রাষ্ট্র হবো, নাকি অমানবিক বিশৃঙ্খলায় আটকে থাকবো?

আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট
[email protected]

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]