‘পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ইনিংসটাই টেস্টে আমার সেরা’

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১১:৪২ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

পাঁচ বছর আগে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে রীতিমত দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বাংলাদেশের। এমন অবস্থায় তামিম আর ইমরুল কায়েস কি অসাধারণ ব্যাটিংটাই না করেছিলেন! কেমন ছিল তাদের সেই জুটিটা?

প্রথম ইনিংসে সবাই মিলে ৩৩২ রানে অলআউট হওয়া দলের দু’জন মাত্র ব্যাটসম্যান কঠিন বিপদে নানামুখি চাপ সামলে কিভাবে ৩১২ রানের এতবড় পার্টনারশিপ তৈরি করে দলকে বিপদমুক্ত করেছিলেন? সে লড়াই-সংগ্রামের গল্পটা আসলে কেমন ছিল?

জুনায়েদ খান, ওয়াহাব রিয়াজ আর ইয়াসির শাহের সাজানে পাকিস্তানি বোলিং সামলাতে কি কি প্ল্যান ছিল তামিম ও ইমরুলের? পাকিস্তানিদের সামলাতে কৌশলই বা কেমন ছিল? নিশ্চিত প্রায় পরাজয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বীরের মত লড়াই- সংগ্রাম করার সাহস, উদ্যম আর দৃঢ় সংকল্পটাই বা জন্ম নিল কি করে?

প্রায় তিন সেশন উইকেটে কাটিয়ে ৩০০ প্লাস রানের পার্টনারশিপে ১৫০ রানের ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখানোর পথে কি রকম, কি কি কঠিন বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল- আজ ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকালে জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে সেটাই শুনিয়েছেন ইমরুল কায়েস। অমন অবিস্মরণীয় ব্যাটিং নৈপুণ্যের পরও সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে এবার আবার টেস্ট দলে জায়গা না পাওয়া নিয়েও কথা বলেছেন ইমরুল।

আসুন শোনা যাক সে গল্প-

জাগো নিউজ : খুলনা টেস্টে দলের বিপদে, প্রয়োজনে তামিম ইকবালের ডাবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি আপনিও দেড়শো রানের বড় ইনিংস খেলেছিলেন। সে ইনিংসটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

ইমরুল কায়েস : বলার অপেক্ষা রাখে না, নিঃসন্দেহে টেস্ট ক্রিকেটে সেটা ছিল আমার সেরা ইনিংস। মানে ওই ইনিংসটার কারণে আমরা নিশ্চিত পরাজয় এড়িয়ে ম্যাচ ড্র করতে পেরেছিলাম। তামিম আর আমার যে জুটিটা ছিল, সেটাও ছিল বিরাট। রীতিমত বিশ্ব রেকর্ড।

Imrul-Kayes

এগুলো যখন মনে হয় তখন খুব ভাল লাগে। মনটা আবেগ আপ্লুত হয়। একটা অন্যরকম ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হই। আর সবচেয়ে বড় কথা ওই ম্যাচের আগে আমি নিজেও অনেক চাপের ভিতরে ছিলাম।

কোচ খেলার আগে আমাকে বলেই দিয়েছিলেন এ যাত্রায় এটাই তোমার শেষ ম্যাচ। শেষ সুযোগ নিজেকে মেলে ধরার। মেন্টালি অনেক প্রেশারে ছিলাম। মানে দলের সঙ্গীন অবস্থা ছাড়াও আমি নিজেও মোটেই স্বস্তিতে ছিলাম না। একটা বড় মনস্তাত্বিক চাপ নিয়েই খেলতে হয়। ওরকম কঠিন চাপ সামলে ভাল খেলতে পেরেছিলাম। দলের নিশ্চিতপ্রায় পরাজয় রোধ করতে পেরেছিলাম- তাই ভাল লেগেছিল খুব।’

জাগো নিউজ : প্রায় ৩০০ রানে (২৯৬) পিছিয়ে পড়ে ব্যাটিংয়ে নামার সময় আপনার আর তামিম ইকবালের পরিকল্পনাটা আসলে কি ছিল? আপনারা কি ভেবে, কোন চিন্তায় কি করার লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিলেন?

ইমরুল কায়েস: ‘আসলে আমরা অতশত কিছু মাথায় আনিনি। আমাদের প্ল্যানিং ছিল খুবই সাধারণ এবং সিম্পল। আমাদের কথা হয়েছিল, আমরা প্রথমে ৫০ রানের জুটি তৈরির জন্য শুরু করবো। এরপর ফিফটি রানের জুটি হবার পর আবার পঞ্চাশ রান যোগ করার চিন্তা শুরু করি। এরপর যখন দেখলাম যে জুটিতে ১০০ প্লাস রান হয়ে গেছে, তখন মনে হলো আমরা যদি পুরো এক সেশন ক্রিজে কাটাতে পারি, তাহলে পরের দিককার ব্যাটসম্যানদের ভাল খেলা সহজ হবে। তারাও খানিক চাপমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারবে।

এরপর সময় গড়ানোর সাথেসাথে, ধীরে ধীরে লক্ষ্যটাও বড় এবং বিস্তৃত হতে থাকে। এক সময় গিয়ে দেখি আমরা সেশন বাই সেশন খেলতে পারছি এবং অনেক সময় উইকেটে কাটিয়ে ৩০০ প্লাস রানের জুটিটাও গড়ে ফেলেছি।

জাগো নিউজ : এটাতো গেল তামিম আর আপনার জুটি গড়ার পিছনের কাহিনী, আপনার নিজের সেঞ্চুরির কথা কিছু বলুন? কখন মনে হলো আপনিও শতরান করতে যাচ্ছেন?

ইমরুল : আসলে টেস্ট খেলাটাই এমন, এখানে সে অর্থে সময়, বল আর রানের তাড়া কম। কাজেই আপনি পঞ্চাশের পর যদি রয়ে সয়ে দেখে আর বলের মেধা-গুনাগুন বিচার করে খেলতে পারেন, তাহলে ফিফটির পর সেঞ্চুরির আশা করাই যায়। আমিও পঞ্চাশ পার করার পরই ভেবেছি দেখে খেলতে পারলে সেঞ্চুরি হয়ে যাবে। তখন কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম। ভাল লাগছিল।

Imrul-Kayes

জাগো নিউজ : তামিম আর আপনার জুটিটা ভাল হয়। তামিম নিজেই ওই টেস্ট ড্র হবার পর জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ইমরুলের সাথে আমার বোঝাপড়া চমৎকার। আমাদের কেমেস্ট্রিটা আসলে ভাল। একজন আরেকজনকে বুঝি। খেলার ধরণটা জানি। তাই জুটি সাজানো সহজ হয়। ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখেন। একটু ব্যাখ্যা করবেন?

ইমরুল : তামিমের খেলা হয়ত এখন একটু চেঞ্জ হয়েছে; কিন্তু তখন তামিম অনেক বেশি অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলতো। আমি তা জানতাম। তার খেলার ধরণ খুব ভাল জানা ছিল। তখন আমি নিজে থেকে খেলার ধরণ ঠিক করে নিতাম। তামিম মারছে। হাত খুলে খেলছে। প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চড়াও হচ্ছে। এখন তাহলে আমার আর আক্রমণাত্মক হবার দরকার নেই।

তখন আমি একটু রয়েসয়ে সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে যতটা সম্ভব তামিমকে স্ট্রাইক দেই। আবার তামিম একটু ধরে রাখার চেষ্টায় থাকলে আমি আবার একটু চালিয়ে খেলার চেষ্টা করতাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, আমরা দু’জনই সময় ও পরিবেশটা খুব ভাল করে বোঝার চেষ্টা করতাম। আসলে তামিম কি করছে? আমার করণীয় কি হবে? আমার কি করা উচিৎ- এটা খুব ভালভাবে উপলব্ধির চেষ্টা ছিল।’

জাগো নিউজ : আপনাদের সামনে বাঁধা ছিল ওই সময়ে পাকিস্তানের দুই দ্রুত গতির বোলার জুনায়েদ খান আর ওয়াহাব রিয়াজ। যারা সুইংও করাতে পারতেন। তাদের মোকাবিলা করতে বিশেষ কোন প্ল্যানিং ছিল?

ইমরুল কায়েস : আসলে জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকলে আর যে কোন ফরম্যাটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললে পেস বল খেলার অভ্যাস হয়ে যায়। তখন ১৪০ কিলোমিটার গতির বলও খুব কঠিন মনে হয় না। আমারও মনে হয়নি। তাই পেস বল নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। সুইংটা সামলানোর কাজ করেছি। তাই সমস্যা হয়নি।

জাগো নিউজ : ওই বিরাট জুটি গড়ার পথে এমন কোন সেশন বা কঠিন সময় আসেনি, যখন কাজটা একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল?

ইমরুল : হ্যাঁ, এরকম একটা কঠিন সময় এসেছিল। যখন জুনায়েদ খান খুব ভাল রিভার্স সুইং করাচ্ছিল। জোরের ওপর রিভার্স করিয়ে ক্রমাগত ইয়র্কার লেংথে বল ফেলছিলেন। যা খেলতে সমস্যা হচ্ছিল। তখন আমি তামিমকে বললাম, জুনায়েদকে খেলতে আমার সমস্যা হচ্ছে। আমি তাকে সামলাতে গিয়ে একটু বেকায়দায় পড়েছি।

তখন তামিম বললো, আমাকে স্ট্রাইক বেশি দে। আমি সিঙ্গেলস নিয়ে তামিমকে স্ট্রাইক দিলাম। তামিম স্বচ্ছন্দে জুনায়েদ খানকে সামলে নিল। আবার একটু পরে ওয়াহাব রিয়াজের বলে তামিমের খানিক সমস্যা হচ্ছিল, তখন তামিম এক, এক নিয়ে আমাকে স্ট্রাইক দিচ্ছিল।

ওভাবেই আমাদের পাকিস্তানি ফাস্ট বোলারদের খেলে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। লম্বা সময় উইকেটে কাটাতে হলে, বড়সড় জুটি গড়তে হলে এমন বোঝাপড়া আর সম্প্রীতি খুব জরুরি। একজন কাউকে স্বচ্ছন্দে ও স্বস্তিতে খেলতে পারছে না, তখন সঙ্গী যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে তাকে মোকাবিলা করে, তাহলে জুটি লম্বা হয়। আমাদেরও হয়েছিল।

জাগো নিউজ : এবার পাকিস্তানের সাথে আবার টেস্ট। তামিম আছেন দলে, আপনিই শুধু নেই। পাকিস্তানের সাথে শেষ সিরিজে টেস্টে ১৫০ রানের দারুণ ইনিংস খেলার পরও রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে জায়গা পাননি। এই না থাকাকে কিভাবে দেখছেন? খারাপ লাগছে কতটা? কোন আক্ষেপ আছে?

ইমরুল : টিম ম্যানেজমেন্ট যেটা ভাল মনে করেছেন সেটাই করেছেন। দেখেন, আমি খুব বাস্তববাদী ছেলে। কাজেই সেভাবে আফসোস নেই। অনুশোচনা বা দুঃখ নেই।

এই কারণে দুঃখ নেই নেই যে, আমি জানি, মাঝে টেস্টে ভাল খেলিনি। সম্প্রতি কয়েকটি ইনিংসে রান পাইনি। একটি ফিফটিও হাঁকাতে পারিনি। তাই এমন অবস্থায় দলে থাকার আশা করি না। আমি খারাপ খেলতে থাকবো, আর আমার জায়গায় একজন ইনফর্ম কেউ সুযোগ পাবে না- এমনটা ভাবতে চাই না আমি।

বরং আমার মনে হয়, আমার অফফর্মে ইনফর্ম কাউকে সুযোগ দেয়াই যুক্তিযুক্ত হয়েছে। যাকে নেয়া হয়েছে, সেও ভাল প্লেয়ার। আর আমাকে নিয়ে কোচের সাথে তা নিয়ে কথা হয়েছে। আমার কোন সমস্যা নেই, আফসোসও নেই। এখন ইনজুরিমুক্ত হয়ে আবার মাঠে নামার অপেক্ষায়। আশা করছি, বিসিএলের পরের পর্বে মাঠে নামবো।

জাগো নিউজ : আপনার কি মনে হয় না, তামিম আর আপনার ওই রেকর্ড ৩০০ প্লাস রানের জুটিটা এ সিরিজেও পাকিস্তানের সাথে ভাল খেলার, বড়সড় ইনিংস সাজানোয় বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে! তামিম আছেন এবারো, সাইফ কি আপনার ভূমিকা নিতে পারবেন?

ইমরুল : অবশ্যই। কারণ তামিম তো রাওয়ালপিন্ডিতে খেলবে। তার তো ওখানে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। আমার মনে হয়, তামিমের সাথে যে খেলবে সে অনেক স্বস্তিতে খেলতে পারবে। কারণ, তামিমের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তামিম যদি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, তাহলে অবশ্যই সঙ্গীর ভাল খেলা সহজ হবে। আর সাইফ ভাল খেলোয়াড়। টেকনিক্যালি বলেন, আর শটস খেলার ক্ষমতাই বলেন- সাইফ ভাল খেলোয়াড়। আশা করছি তামিম-সাইফের জুটিও হবে চমৎকার।

এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।