স্কুল খুললেও শিশুদের বেশি চাপ দেওয়া যাবে না
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত দেড় বছর শিশু-কিশোররা অনেকটা গৃহবন্দি। ঘরে বসেই কাটছে তাদের দিনরাত। কিছু স্কুল অনলাইনে ক্লাস চালালেও কার্যত শিশুরা বাইরের আলো-বাতাস পেয়েছে কম।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেশের বিনোদনকেন্দ্রগুলোও বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় শিশুদের প্রায় সবকিছুই টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট আর ইনডোর গেমসকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাই স্কুল খুললেও শুরুতেই তাদের বেশি চাপ না দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ঘরবন্দি শিশুদের দিনকাল কাটছে কেমন? এ অবস্থায় শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক কী পরিবর্তন হয়েছে? ভবিষ্যতে এসব প্রভাব কেমন হতে পারে? এসব নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোসা. আখতারা বানু। ‘চাইল্ড পারসোনালিটি’ বিষয়ে পিএইচডি করা এই অধ্যাপক দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে মনোবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করছেন তিনি।
শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি নাহিদ হাসান।
জাগো নিউজ: দীর্ঘদিন ঘরবন্দি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক কী পরিবর্তন হচ্ছে?
ড. আখতারা বানু: শিশুরা দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। নিজের অজান্তেই এমন অভ্যাস গড়ে তুলছে যা তাদের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের দেশে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমরা মেন্টাল হেলথকে গুরুত্ব দেই না। অধিকাংশই শুধু শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা করে। মনোজগতে যে কত রকমের সমস্যা হচ্ছে, এ ব্যাপারে অবিভাবকদের তেমন কোনো চিন্তা নেই। মানসিক সমস্যার শেকড় থাকে অনেক গভীরে। এই সমস্যা যদি শিশুদের মনে দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে তাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কষ্টকর হবে।
জাগো নিউজ: গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা মোবাইল-ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ভবিষ্যৎ প্রভাব...
ড. আখতারা বানু: মোবাইল বা ইন্টারনেটে আসক্তির ফলে শিশুদের মেধা বা সৃজনশীলতা খর্ব হচ্ছে। শিশুরা সুস্থ চিন্তা করতে পারছে না। অনেক শিশু গেমস, ফেসবুকে আসক্ত হচ্ছে। এ ধরনের গেমসের ফলে শিশুদের মনে ধ্বংসাত্মক মনোভাব চলে আসছে। পরবর্তীসময়ে এর প্রভাব খুবই নেতিবাচক হবে। আবার শিশুদের হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট সুবিধা থাকায় অনেক সময় তারা অ্যাডাল্ট ভিডিও দেখছে। ফলে তারা ওই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যেটা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এর নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি। এভাবে চলতে থাকলে পরে এ থেকে শিশুদের বের করে আনা কষ্টসাধ্য হবে।
জাগো নিউজ: শিশুদের আচরণগত কী পরিবর্তন আসতে পারে?
ড. আখতারা বানু: শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে এমন অনেক সমস্যা নিয়ে অভিভাবকরা আসছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিশুরা আগে যেমন পড়ালেখা করতো বা ফলাফল করতো তেমনটা নাও করতে পারে। অনেক শিশুর মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর আগ্রহ, অনুপ্রেরণা ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আগে যেসব শিশুর পড়ালেখা বা বাইরে খেলাধুলার আগ্রহ ছিল এখন সেই আগ্রহটা স্মার্টফোনের উপর। এটা আসলে খুবই ক্ষতিকর। শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়তে পারে। তবে অনেক শিশু আছে যারা বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ জিনিস তৈরি করছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো দিক।
জাগো নিউজ: কীভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া যায়?
ড. আখতারা বানু: ঘরবন্দি এই সময়ে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ব্যায়ামটা জরুরি। বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম থাকায় বাসার ছাদে বা ঘরের মধ্যেই এগুলো করতে পারে। শুধু যে শিশুরাই করবে তা নয়, বাবা-মাও করবে। শরীর সুস্থ থাকলে মানসিক সুস্থতাও আসে। অনেক শিশুর ডায়াবেটিস, ওবিসিটি দেখা দিয়েছে। এর কারণ সারাক্ষণ ঘরে বসে অনলাইনে আসক্তি। শিশুদের সময় দিয়ে গল্প করা, আড্ডা দেওয়া প্রয়োজন। এটা মানসিক সুস্থতার জন্য অনেকটা সহায়ক। ঘরের মধ্যে যতটা সম্ভব সাংস্কৃতিক চর্চা করতে পারে। শিশুরা অতিমাত্রায় মানসিক বিষাদগ্রস্ত হলে দ্রুত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
জাগো নিউজ: এসময় বাবা-মায়ের আচরণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ড. আখতারা বানু: গবেষণায় দেখা গেছে বাবা-মায়ের মধ্যে যদি কলহ থাকে বা প্রতিনিয়ত ঝগড়া হতে থাকে তাহলে শিশুর মনোজগৎ ভেঙে-চুরে যায়। শিশুরা সব সময় চায় বাবা-মা মিলেমিশে থাকবে এবং তাদের ভালোবাসবে। বাবা-মায়ের মধ্যে যদি অশান্তি থাকে তাহলে অনেক সময় সেটা তারা লুকাতে পারে না। এসব কারণে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য শিশুর সামনে বাবা-মাকে সংযত আচরণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে হবে। তবে সেটা একান্তভাবেই হতে হবে।
জাগো নিউজ: যেসব শিশু-কিশোর একাকী থাকছে তাদের জন্য পরামর্শ...
ড. আখতারা বানু: এক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনলাইনে শিশু-কিশোররা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারে। দেখা যায় কোনো শিশু ভালো ছবি আঁকতে পারে। সে ছবি এঁকে তার অন্য বন্ধুদের দেখাতে পারে। এতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিয়েটিভ কিছু চিন্তা করবে। এতে শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটবে। এছাড়া শরীরচর্চা, পরিবারের সঙ্গে গল্প করা, বাবা-মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করতে পারে।
জাগো নিউজ: অনেক অভিভাবক কর্মহীন। এমন পরিস্থিতিতে...
ড. আখতারা বানু: অভিভাবকদের মধ্যে অনেকেই কর্মহীন হওয়ার ফলে অনেক পরিবারই ঠিকমতো শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। সাইকোলজিতে আছে ‘চাহিদা তত্ত্ব’। মৌলিক চাহিদা থাকবে সবার নিচে। এটা হলো ভিত্তি। অনেকটা পিরামিডের মতো। এক্ষেত্রে প্রথম চাহিদা অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা যদি পূরণ না হয় তাহলে দ্বিতীয় চাহিদা সৃষ্টিই হবে না। এমন অবস্থায় বাবা-মায়ের মানসিক চাপ বা অশান্তি শিশুর ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জাগো নিউজ: শিশুদের নেতিবাচক মানসিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কোভিড পরবর্তী ব্যবস্থা?
ড. আখতারা বানু: শিশুরা যেহেতু দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে পড়ালেখার জন্য তাদের আগের মতো চাপ দেওয়া যাবে না। কারণ হঠাৎ করে এত চাপ তারা নিতে পারবে না। সেজন্য সিলেবাস কমিয়ে শিশুদের মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে হবে। বাবা-মা ও শিক্ষকদের সব সময় উচিত হবে পড়ালেখার প্রতি বেশি চাপ না দেওয়া। অবশ্য ধীরে ধীরে তারা অভ্যস্ত হয়ে যাবে। সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের উপর জোর দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি শিক্ষকদেরই নজর দিতে হবে। তাদের সৃজনশীল কাজে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. আখতারা বানু: ধন্যবাদ আপনাকেও...
নাহিদ হাসান/এএ/জিকেএস