সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার গল্প শোনালেন সাদিয়া

পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ এবং অদম্য ইচ্ছা শক্তিতেই ১৭তম বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে সহকারী জজ হিসেবে সারাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হালিমাতুস সাদিয়া। নিয়মিত অধ্যবসায় তাকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। এখন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ন্যায় বিচারক হওয়ার প্রত্যাশা তার।
হালিমাতুস সাদিয়া বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার লোহালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা রহমান কবির ও মা নাসিমা আক্তার। পড়াশুনার তাগিদে থাকেন নগরীর কাশিপুর লাদেন সড়কে ভাড়া বাসায়। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে হবেন বিচারক। সেই বিচারক হওয়ার গল্প জাগো নিউজকে শুনিয়েছেন হালিমাতুস সাদিয়া।
আরও পড়ুন-
সাদিয়া বলেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রোববার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন থেকে আমার রেজাল্ট আমিই প্রথম দেখেছি। রেজাল্ট দেখার সময় সবার প্রথমেই আমার রোল দেখেতো আমি হতবাক। তখন আমার মনে হয়েছিল ১৭তম বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষায় সারাদেশে প্রথমবারের মতো প্রথম হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি বলেন, বিজেএসের প্রিপারেশন রাতারাতি হয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এটার জন্য একটা লং জার্নির দরকার। আমি প্রকৃতপক্ষে আমার অ্যাকাডেমিক লাইফের শুরু থেকেই পড়াশোনায় নিয়মিত ছিলাম। ২০১৭-২০১৮ সেশনে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হয়ে আমার যখন প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল রেজাল্ট হয়, তখন আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। এর আগে কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে আমাকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হবে, তবে যখন হয়েছি তখন সেটি ধরে রাখার কথা চিন্তা করি। এই ধারাবাহিকতায় এলএলবিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং এলএলএমেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে উত্তীর্ণ হই।
তিনি বলেন, অ্যাকাডেমিক লাইফে পড়াশোনা করেছি, শিক্ষকদের ক্লাস মনোযোগ সহযোগে করেছি, প্রত্যেকটি ক্লাস ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড লিখেছি, এমনকি তারা একটা হাঁচি দিলেও আমি লিখে রাখতাম। এককথায় তাদের মুভমেন্ট ফলো করতাম, যাতে বাসায় বসে পড়তে গিয়ে সেটি রিকল করতে পারি।
তিনি বলেন, স্কুল জীবনে যখন আমি বুঝতে শিখি তখন থেকেই কখনো অন্য মেয়েদের মতো ডাক্তার হতে চাইনি, আমি চেয়েছি এমন একটা প্রফেশনে যেতে যেটা গতানুগতিক কেউ চয়েজ করে না। সেই প্রফেশন আমার নলেজে না থাকলেও আমার বাবার (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রহমান কবির) কাছ থেকে প্রথম এই প্রফেশনের বিষয়টি জানতে পারি। এরপর যখন বুঝতে শিখেছি এইম ইন লাইফ কী, তখনতো চিন্তা-ভাবনা আরও স্বচ্ছ হয়। স্কুল-কলেজ জীবন শেষে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স পাই এবং এখানেও ভর্তি পরীক্ষায় ১৩তম হই।
আরও পড়ুন-
- নারীরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে না, সুযোগ সৃষ্টি করবে
- শত শত প্রতিবন্ধীকে স্বাবলম্বী করে চলেছেন ৩৯ ইঞ্চির অদম্য হোসনা
তিনি বলেন, এলএলএম শেষ হওয়ার পর বিজেএসের জন্য ফুললি ফোকাস করি। আমার এ সফলতার অংশীদার আমি একা নই। এর সঙ্গে মিশে আছে আমার মা-বাবার অসংখ্য নির্ঘুম রাত।
তিনি বলেন, আমি যখন পড়তাম তখন আমার স্কুল শিক্ষিকা মা (নাসিমা আক্তার) আমার পাশে বসে থাকতেন। চাকরি ও সংসারের সব কাজ করেও আমার জন্য রাত জেগে থাকতেন। আম্মু সবসময় বলতেন তিনি ঘুমিয়ে পড়লে কি আমি ভয় পাবো। মা আমার জন্য অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বলেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসরুম, বই, শিক্ষক সংকট থাকে। আমি যখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখন কোনো অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন না। ছিলেন লেকচারার আর সহকারী অধ্যাপক। কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষকদের মাঝে কখনো আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না, যেটি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ছিল।
হালিমাতুস সাদিয়া বলেন, আমি আইনে কাদামাটি ছিলাম, আর সেই কাদামাটিকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামো দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে নিয়মিত পড়াশোনা করতে হবে এবং ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। আর কয় ঘণ্টা পড়লাম এটার থেকে আমি কী পড়লাম সেটির দিকে ফোকাস করতে হবে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সাদিয়া। বাবা মা দুজনই স্কুলশিক্ষক। তবে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় মাদরাসা দিয়ে। পরে ২০১৫ সালে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি এসএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ও আইন বিভাগের পঞ্চম ব্যাচের শিক্ষার্থী তিনি। টানা চতুর্থবার প্রথম স্থানকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করায় তার অর্জনে বাবা-মা ভাই-বোনসহ শিক্ষার্থীরা আনন্দিত। সফলতার বিষয়ে হালিমাতুস সাদিয়া সকলের নিকট দোয়া প্রার্থনা করেছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শারমিন বলেন, সাদিয়াসহ এ বছর ৩ জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের শিক্ষর্থীরা যেকোনো জায়গায় যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে তারই উদাহরণ সহকারী জজে চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করা।
এফএ/এমএস