‘হার ই-ট্রেড’র নবম আসর

নারী উদ্যোক্তাদের কল্যাণে নতুন দিগন্ত

মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ
মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:১৮ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় নারী উদ্যোক্তাদের অবদান প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মসংস্থান তৈরি এবং বেকারত্ব দূরীকরণে তাদের ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।

লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামগ্রিক সামাজিক অগ্রগতি অর্জনে তাদের উদ্যোগসমূহ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এরই অংশ হিসেবে দেশীয় নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে রাজধানীর ধানমন্ডিতে চলছে দুই দিনব্যাপী ‘হার ই-ট্রেড’এর নবম আসর। শুক্রবার (৭ মার্চ) ধানমন্ডির অরচার্ড কনভেনশন হলের লেভেল ৪-এ এটি উদ্বোধন করা হয়।

ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে এ আয়োজনে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা তাদের তৈরি বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মোট ৭৩ জন ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তা নবম ‘হার ই-ট্রেড’ এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করছেন। তারা প্রত্যেকেই দেশীয় কাঁচামাল-নির্ভর উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেন।

‘হার ই-ট্রেড’র নবম আসর, নারী উদ্যোক্তাদের কল্যাণে নতুন দিগন্ত

এ আয়োজনে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি, ব্লাউজ, জুয়েলারি, কুর্তি, থ্রি-পিস, লেডিস পাঞ্জাবি, ওয়ান পিস, হোমমেড আচার, ফুলের মালা, ব্যাগ, পার্স, শোপিস, ঘর সাজানোর নানান সামগ্রী, বাচ্চাদের ড্রেস, ম্যাচিং গয়না ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে।

'ক তে কাপড়'-এর স্বত্বাধিকারী স্নিগ্ধা রানি সরকার জাগো নিউজকে বলেন, আমি এবং আমার পার্টনার ইফাত আরা। আমরা দুজন মিলে এ উদ্যোগটা শুরু করি। আমরা দুজনই চাকরি করতাম। একটা সময় চাকরি করতে করতে মনে হলো যে নিজেদের কিছু একটা করবো। পরে দুজন মিলে পরিকল্পনা করতে করতে এ উদ্যোগটা শুরু করা। এর মধ্যে ৮ বছর হয়ে গেছে। খুব জলদি আমরা ৯ বছরে পা দেবো।

তিনি বলেন, বিশেষ করে শাড়ি, কাপড়, ডাইং, সুতি, টাঙ্গাইল, হ্যান্ডলুম কটন ইত্যাদি নিয়ে আমরা কাজ করি। এখন ‘ক তে কাপড়’ বললেই ডাইং এর যত প্রকার আছে সেটা নিয়ে মানুষ আমাদের চেনে। আমাদের কটন ডাই শাড়ি, টাঙ্গাইল কটন, স্ক্রিন প্রিন্ট, স্লিল্কের ডাইং থ্রি-পিস, কটন ডাই টু-পিস, রেয়ন সিল্কের শাড়ি, মসলিনে ডাই করা শাড়ি, রেডিমেড কুর্তি, স্কার্ফ, ওড়না, হ্যান্ডলুম কটনের ওড়না, মেশিন ওড়না, ছেলেদের পাঞ্জাবীসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমার এখানে আছে। প্রতি বছর চেষ্টা করি নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করবো। সে ধারাবাহিকতায় সামনে আরও নতুন অনেক পণ্য সংযোজন হবে।

‘হার ই-ট্রেড’র নবম আসর, নারী উদ্যোক্তাদের কল্যাণে নতুন দিগন্ত

এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা আছেন এবং প্রতি বছর এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রত্যেকে কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে। এটা খুবই অ্যাপ্রিশিয়েবল। কারণ মেয়েরা অনেকে ঘরে বসে না থেকে কিছু করার চেষ্টা করছেন। অনেকে এর মাধ্যমে সংসার চালাচ্ছেন। মেয়েদের ঘর সংসার সামলাতে হয়। তার পাশাপাশি যারা নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন তারা নিজেরা উদ্যমের সঙ্গে কাজ করছেন বলেই টিকে আছেন। আমি চাইবো নারীদের পাশে যেসব ভাই, বাবা, স্বামী যারা আছেন তারা সবাই নারীদের সাপোর্ট করুন। আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তা আমাদের দেশে তৈরি হোক।

'ইচ্ছে পূরণ'-এর স্বত্বাধিকারী তানজিল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, আমি এবং মোনালিসা আলম আমাদের দুজনের উদ্যোগ 'ইচ্ছে পূরণ'। এটার শুরু আমাদের মনের ইচ্ছা থেকে। ছোটবেলা থেকেই আমরা নিজেদের ড্রেসে বিভিন্ন ব্লক, বাটিক ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতাম। সেখান থেকেই ইন্সপিরেশন নিয়ে ২০১৭ থেকে আমাদের এ উদ্যোগের শুরু। আমাদের কথা হচ্ছে অন্যেরটা দেখে দেখে করা না। যেটা আমরা পারি, নিজের দক্ষতা, সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানো।

তানজিল আহসান বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের আমি বলবো কাউকে কপি করে কোনো কাজ না করে আপনার জ্ঞানগর্ভে যতটুকু আছে সেটা দিয়েই শুরু করুন। আপনার মনের ক্ষুধা থেকে আগান। দেখবেন কাজের প্রচারও বাড়বে, প্রসারও হবে।

তার মতে, নারীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ শুরু হয়ে ঘর থেকে। ঘর থেকে যদি আমরা সাপোর্ট পাই তাহলে কিন্তু আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি। দেখা যায় অনেকে কাজ করতে চাচ্ছে। কিন্তু শুধু সাপোর্ট না থাকার কারণে শুরু করতে পারছে না। আমি ১৬ বছর চাকরি করেছি। এরপর ব্যবসা শুরু করেছি। আমি মনে করি কোনো মেয়েরই বসে থাকা উচিত না। সবারই কিছু না কিছু ইনকাম সোর্স থাকা উচিত। মানুষের কাছে কত চাওয়া যায়? কারও মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে নিজে থেকে কিছু একটা করা, যাতে দিনের শেষে ভাবতে না হয় যে আমার কাছে কিছু নাই, আমি কীভাবে কী করবো?

'জাফনাহ কালেকশন'-এর স্বত্বাধিকারী মহসিনা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, আমার উদ্যোগের বয়স ৪ বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখন চাকরি করা একটু কঠিন ছিল। সেজন্যই ব্যবসায় আসা। আমি মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলাম। সেখান থেকে আজ এখানে।

আমি মূলত জামদানি নিয়ে কাজ করি যা আমার সিগনেচার প্রোডাক্ট। যতগুলো তাঁতের কাপড় আছে তার মধ্যে জামদানি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তাই আমি এটি নিয়ে কাজ করার চিন্তা করি। তাছাড়া জামদানির এত বেশি ভ্যারাইটি যে দামের সঙ্গে পণ্যের কোয়ালিটি মেনটেইন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। ফলে অনেকে প্রতারণার শিকার হন। তাই আমার চেষ্টা ছিল খুব রিজনেবল প্রাইসে ভালো জামদানি কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

'আমাদের কোনো ফিজিক্যাল শপ নেই। আমরা সম্পূর্ণ অনলাইনে ব্যবসা করি। এছাড়া অন্যান্য লোকাল ফ্যাশন হাউজ থেকে অনেক স্বল্প মূল্যে একই মানের পণ্য আমাদের এখান থেকে পাওয়া যায়। কারণ জামদানি পল্লির তাঁতি সবাই এক। তাই ক্রেতারা দামি ব্র্যান্ডে না গিয়ে আমাদের থেকে কিনলে সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো পণ্য পেতে পারেন।'

মেলায় আসার কারণ হিসেবে বলবো, প্রচার-প্রসার। মেলা শেষে আমরা অনেক অর্ডার পাই। মেলায় এসে ক্রেতা পণ্য ধরে দেখতে পারেন যে পণ্যের মান কেমন। তাই অনেকে এখানে এসে দেখে আমাদের নক করেন। এছাড়া আমাদের পণ্য সারা বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরেও ডেলিভারি দিয়ে থাকি। আমাদের অনেক বিদেশি রিপিটেড ক্লায়েন্ট আছে যাদের কাছে আমরা পণ্য বিক্রি করি। তারা নারী উদ্যোক্তাদের অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়।

'যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো, একসঙ্গে অনেক বেশি বিনিয়োগ না করে অল্প করে শুরু করা উচিত। কারণ, আপনি জানেন না যে কতটুকু ব্যবসা রান করতে পারবেন। এজন্য অল্প ইনভেস্ট করে আগে বাজার বুঝতে হবে। ধৈর্য ধরে লেগে থাকলে একসময় হয়ে যায়।'

‘হার ই-ট্রেড’র নবম আসর, নারী উদ্যোক্তাদের কল্যাণে নতুন দিগন্ত

মেলায় সাইফা নামের একজন দর্শনার্থী বলেন, আমি প্রতিবারই এ মেলায় আসি, খুব ভালো লাগে। এখানে অনেক কম দামে ডিজাইনার কালেকশন পাওয়া যায়। ঈদের জন্য আমি একটা থ্রি-পিস কিনেছি। আর কিছু গয়না কিনেছি আম্মুর জন্য।

মেলায় সাইমন নামে একজন বিদেশি দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। নিচে একটা ব্যানার দেখে এলাম। চারদিক ঘুরে দেখছি, কিছু পছন্দ হলে কিনবো।

হার ই-ট্রেড ট্রাস্টের সভাপতি ওয়ারেছা খানম প্রীতি জাগো নিউজকে বলেন, হার ই-ট্রেড মূলত দেশীয় উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে। যারা দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর পণ্য নিয়ে যারা কাজ করছে সে উদ্যোক্তাদের সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে আসলে হার ই-ট্রেড ট্রাস্ট কাজ করে।

সাপোর্ট সিস্টেম কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা জানি যে আমাদের উদ্যোক্তারা সৃজনশীল। তারা ভীষণ ক্রিয়েটিভ কাজকর্মগুলো করেন। কিন্তু সে কাজগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া কিংবা প্রচার, প্রসার, প্রমোশন, নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন, যে কাজটায় তিনি পারদর্শী হতে পারেন, তাকে আরেকটু অ্যাডভান্স ট্রেনিং দিলে আরও ভালো করবে। এই সাপোর্টগুলো আসলে হার ই-ট্রেড ট্রাস্ট দিয়ে থাকে।

'আমরা দেখি যে বিদেশি পণ্যের জৌলুসে আমাদের দেশি পণ্যগুলো অনেকটাই ম্লান। কিন্তু দেশি পণ্যের খুব এক্সক্লুসিভ একটা কমিউনিটি আছে যারা এটাই পছন্দ করে। আমাদের টার্গেট এরকম কাস্টমার বেজ, যারা দেশীয় উদ্যোগকে পছন্দ করেন এবং ক্লাসটাকে মেনটেইন করেন। আমরা চিন্তা করলাম যে, দেশীয় পণ্য আসলে আমাদের দেশের সম্পদ। একে যদি আমরা ব্যবহার করি, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি তাহলে দেশের উন্নতি হবে। আসলে সে উদ্দেশ্যেই কিন্তু আমাদের এই দেশীয় উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা।'

ওয়ারেছা খানম প্রীতি বলেন, আমরা প্রচার প্রচারণার জন্য যে এক্সিবিশন করি, এটার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমরা কোনো ফান্ড পাই না। কোনো স্পন্সর পাই না। আমরা দুই দিনের এই এক্সিবিশন করছি। আমার ধারণা এটা ৫ দিন হলে আরও ভালো হতো। কিন্তু করতে পারি না এ কারণে যে আমাদের কোনো ফান্ডিং নাই।

এসআরএস/এমএইচআর/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।