রক্তদাতা নারী

রোজা রেখেও রক্ত দিয়েছেন নিগার

লাইফস্টাইল ডেস্ক
লাইফস্টাইল ডেস্ক লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:০৯ এএম, ০৮ মার্চ ২০২৫
নাহিদ নিগার

মোস্তাক আহমেদ

‘চার মাস পর পর যখন কোয়ান্টাম ল্যাব থেকে ফোন আসে, তখন রক্তের জন্যে অপেক্ষমান অসহায় মুখগুলো ভেসে ওঠে মনের চোখে। নিজের ভেতর তাগিদ অনুভব করি কখন রক্ত দিতে যাবো।’ সম্প্রতি পঞ্চাশতম ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন তিনি। কেন দিচ্ছেন রক্ত? জানতে চাইলে কথাগুলো বলছিলেন ৫৭ বছর বয়সী স্বেচ্ছা রক্তদাতা নাহিদ নিগার।

নাহিদ নিগার একজন গৃহিনী, তার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। ২০০৪ থেকে ২০২৪, টানা বিশ বছর কোয়ান্টাম ল্যাবে নিয়মিত রক্তদান করছেন। সম্প্রতি ৫০তম বার রক্ত দিয়েছেন তিনি। জানালেন, কোয়ান্টামে শুরু করার আগেও বেশ কবার বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় ২০ বার রক্ত দিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। সব মিলিয়ে হিসেব করলে তার রক্তদানের সংখ্যা ৭০ বার।

কলেজে পড়াকালীন রক্তদানের ইচ্ছা জাগে তার। রক্ত দিতে গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ তখন তার ওজন ছিল কম। তারপর ওজন স্বাভাবিক হতেই তিনি রক্তদান শুরু করেন। ঘরের সব কাজ সামলে, পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে তিনি বেরিয়েছেন মানবসেবায়। নিগার বলেন, ‘শুধু সেবা করবো, এমন মানসিকতার পাশাপাশি প্রচন্ড এক ভালোলাগা কাজ করছিল আমার ভেতর। পরিবারের সদস্যরা সব সময় আমাকে সহযোগিতা করেছেন।’

রোজা রেখেও রক্ত দিয়েছেন নিগারনাহিদ নিগার। ছবি: জাগো নিউজ

নিয়মিত রক্তদান অপার্থিব আনন্দ দেয় নিগারকে। রক্ত দেওয়ার অনুভূতি আসলে কেমন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন একব্যাগ রক্ত দিই, ল্যাব থেকে বেরোতেই ফুরফুরে লাগে। মনে হয়, আমি যেন প্রজাপতির মতো উড়ছি। এই ভালোলাগা রক্ত না দেওয়া কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।’

কোয়ান্টাম ল্যাবের অর্গানিয়ার শামীমা নাসরিন মুন্নী বলেন, ‘ল্যাব থেকে যখনই ফোন করা হয়, নাহিদ নিগার আপা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ল্যাবে এসে আন্তরিকতার সঙ্গে রক্ত দিয়ে যান। তার মতো দাতারা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছেন বলেই আমরা অসহায় মুমূর্ষুকে সেবা দিতে পারছি।’ একজন গৃহিনী হয়েও পরিবারের দায়িত্ব সামলে নিয়মিত রক্তদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীরা এখন অনেক এগিয়ে গেছেন। ঘরে-বাইরে সবখানে তাদের অবদান এখন চোখে পড়ার মতো। আর রক্তদান বিষয়ে বলব, পুরুষ কিংবা নারী, আসলে মুমূর্ষের প্রয়োজনে মানবিক ইচ্ছাটাই বড় কথা।’

রোজার সময় ল্যাবগুলো রক্তের সংকট থাকে। অথচ রোজা রেখেও রক্ত দেওয়া যায়। নাহিদ নিগার বলেন, ‘আমি রোজা রেখেও কয়েকবার রক্ত দিয়েছি।’ রক্ত দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নাহিদ নিগার বললেন, ‘এক ছেলের খালার জন্য বইমেলায় একবার রক্ত দিয়েছিলাম। দুদিন পর ছেলেটি আমার সাথে দেখা করে জানিয়ে যায়, তার খালা ভালো আছেন। ছেলেটা জানায়, তার খালা ও পরিবারের সবাই আমার জন্য দোয়া করেছিলেন। আর একবার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক শিশুর জন্য রক্ত দিয়েছিলাম। বাচ্চার বাবা আমার সামনে খুব কাঁদছিলেন। তিনি আমাকে অনেক দোয়া করেছিলেন। জীবনে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।’

রোজা রেখেও রক্ত দিয়েছেন নিগাররাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) মিলনায়তনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত স্বেচ্ছা রক্তদাতা সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিক মোসাদ্দিকের হাত থেকে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন নাহিদ নিগার। উপস্থিত ছিলেন ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মাদাম নাহার আল বোখারী, পরিচালক মোটিভেশন এম রেজাউল হাসান। গত ৫ ফেব্রুয়ারির ছবি।

তরুণ প্রজন্মকে তিনি রক্তদানের মতো মহৎ কাজে আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সব নারী রক্ত দিতে সক্ষম নন। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনেই রক্ত দিতে হবে। নারীদের রক্তদান বিষয়ে শামীমা নাসরিন মুন্নী জানান, ২০০০ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে কোয়ান্টাম ল্যাবে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার নারী রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার নারী নিয়মিত রক্তদাতা। নাহিদ নিগারের মতো ৫০তম বার দিয়েছেন এমন আরো একজন নারী রক্তদাতার নাম আনোয়ারা বেগম সোমা (এবি+)। এ ছাড়াও প্রায় দেড় শ নারী রক্তদাতা রয়েছেন যারা পঁচিশবারেরও বেশি রক্ত দিয়েছেন।

যে নারীরা রক্ত দেবেন না

  • যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম। রক্ত দেওয়ার জন্য হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ন্যূনতম ১১ গ্রাম বা ডেসিলিটার হতে হবে।
  • যাদের রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক নয়।
  • যাদের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে।
  • সন্তান জন্মদানের এক বছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
  • রক্তবাহিত রোগ, যেমন হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’, জন্ডিস, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি
  • রোগে আক্রান্ত নারীরা। এ ছাড়া টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, বাতজ্বর, হৃদ্‌রোগ থাকলেও রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
  • যারা অন্তঃসত্ত্বা এবং যাদের ঋতুস্রাব চলছে, তারাও রক্ত দেবেন না।

কেমোথেরাপি ও হরমোন থেরাপি নিচ্ছেন, অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন তারা রক্ত দেবেন না। যাদের বিগত ছয় মাসের মধ্যে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়েছে, তারা রক্ত দেবেন না। আরও যা লক্ষ রাখতে হবে যাদের অতিরিক্ত ঋতুস্রাব হয়, তারা বিশেষ সতর্ক থাকবেন এবং নিয়মিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করবেন। হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকলে তারা রক্ত দিতে পারবেন। তবে ঋতুচক্রের যেকোনো সমস্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

রক্তদাতা নারীদের নিয়মিত ও পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পানি পান করতে হবে। খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে পর্যাপ্ত ফল, সবজি, প্রাণিজ আমিষ এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার। গরু, খাসি ও মুরগির মাংস, প্রাণীর অঙ্গ, যেমন গিলা, কলিজা, গোর্দা, কিডনি ইত্যাদি, পেয়ারা, আপেল, তরমুজ, খেজুর, বেদানা, কলা, আঙুর, কিশমিশ এবং বিভিন্ন শুকনা ফল, নানা রকম বাদাম, লালশাক, কচুশাক, মিষ্টিকুমড়া প্রভৃতি আয়রনের সমৃদ্ধ উৎস। এসব পরামর্শ দিয়েছেন রক্তরোগ ও রক্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন।

আরএমডি/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।