তিনবার আত্মহত্যা করতে যাওয়া দোলা এখন সফল উদ্যোক্তা

অভাব আর শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের শিকার হয়েও রহিমা আরা দোলা স্বপ্ন দেখতেন ভালোভাবে বাঁচার। কিন্তু যখন পর পর দুটি সন্তান মারা যায় তখন তার বাঁচার ইচ্ছাও চলে যায়। তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সেই মনোবল হারানো দোলা আজ অনেক নারীর কাজের অনুপ্রেরণা।
তিনটি জামা ও ২০ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করা কাপড়ের ব্যবসায় আজ তিনি স্বাবলম্বী। একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন দোলা ফ্যাশন হাউজ ও পার্লার। সেখানে কাজ করছেন সাতজন অবহেলিত নারী। এছাড়াও দেড় শতাধিক নারীকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও মনোবল কাজে লাগিয়ে আজ তিনি সমাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত বছর পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কারও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালী জেলার জয়নাল আবেদিনের মেয়ে রহিমা আরা দোলার (৩৮) সঙ্গে ২০০১ সালে মাদারীপুর সদর উপজেলার পাগদী এলাকার আ. ওহাব বেপারীর ছেলে কামাল বেপারীর (৪৫) পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। ১৪ বছর বয়সে দোলার মা মারা যান। এরপর ২০০১ সালে বাবাও মারা যান। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িকে আপন ভাবলেও শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অনেকবার ভেবেছিলেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন, মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। তাই বাধ্য হয়ে নির্যাতন সহ্য করে স্বামী ও ছেলে রাতুলকে নিয়ে দিন পার করছিলেন।
আরও পড়ুন-
২০১১ সালে আট বছরের ছেলে রাতুলকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দোলার হাত থেকে ছুটে গিয়ে অটোরিকশার নিচে চাপা পড়ে রাতুল। সেই ঘটনায় মারা যান একমাত্র ছেলে। ছেলেকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন দোলা। কোনোভাবেই ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলেন না। এরমধ্যে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছেলের মৃত্যুর জন্য দোলাকেই দায়ী করতে থাকেন। এতে করে তিনি আরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এক পর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তার দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে এলে কিছুটা স্বস্তি আসে জীবনে। জন্মের পর ধরা পড়ে ছেলে হৃদরোগে আক্রান্ত। অভাবের সংসারে শুরু হয় আবার ছোটাছুটি। দীর্ঘ দশ মাস বিভিন্ন ডাক্তারের পেছনে ছুটতে ছুটতে টাকা পয়সা সব শেষ হয়ে যায়। এমনকি শেষ সম্বল বিয়ের একটি গহনাও বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করেন। তবুও ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। শেষ সময়ে টাকার অভাবে ডাক্তারও দেখাতে পারেননি। আবারও ভেঙে পড়েন তিনি, সিদ্ধান্ত নেন আত্মহত্যার। ঠিক ওই সময় যুব উন্নয়নে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেন দোলা। টেইলার্স, বুটিক, ব্লক ও বাটিকের কাজ শেখেন। পাশাপাশি শেখেন পার্লারের কাজও।
২০০৮ সালের কথা। ওই সময় ৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনে তা বড় করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। সেই ২০ হাজার টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন ও কিছু কাপড় কেনেন। তিনটি জামার ডিজাইন করেন। সেই ডিজাইন আশপাশের মানুষের পছন্দ হয়। সেই থেকে শুরু হয় তার নতুন পথচলা। মাদারীপুর শহরের পাগদী এলাকার স্বামীর টিনের ঘরের বারান্দায় গড়ে তোলেন দোলা ফ্যাশন হাউজ ও পার্লার ব্যবসা। টিনের বেড়া ও মাটির মেঝের বারান্দায় বেড়া দিয়ে একপাশে পার্লার, অন্যপাশে টেইলার্স। হাতে সেলাই ও থ্রিপিস বিক্রিও শুরু করেন।
আরও পড়ুন-
- শত শত প্রতিবন্ধীকে স্বাবলম্বী করে চলেছেন ৩৯ ইঞ্চির অদম্য হোসনা
- শিক্ষায় এগিয়ে থেকেও চাকরিতে পিছিয়ে নারী
একটু একটু করে ব্যবসা বাড়তে থাকে। আশপাশের মানুষ তার কাছে বিভিন্ন ডিজাইনের জামা কাপড় কিনতে ও বানাতে শুরু করেন। এরপর ২০১৫ সাল থেকে তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। ব্যবসায় সফলতা দেখতে শুরু করেন।
দোলা মাদারীপুরের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রায় দেড় শতাধিক নারীকে সেলাইয়ে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বর্তমানে তার ডিজাইন করা ও বিভিন্ন সেলাই নকশার কাজ করেন সাতজন নারী। তারা অবসরে এসে দোলার কাছ থেকে কাজ বুঝে নেন। এরপর কাপড়, সুঁই ও সুতা নিয়ে যার যার বাড়িতে চলে যান। সেখানে কাপড়ে নকশা করেন। কুশিকাটার কাজও করেন। কাজ শেষ হলে সেই কাপড় দোলাকে বুঝিয়ে দিয়ে পারিশ্রমিক নেন। টেইলরিং কাজের পাশাপাশি সেলাই ও পার্লারের কাজ করে মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় করেন দোলা।
গত বছর মাদারীপুর মহিলা অধিদপ্তর থেকে জয়িতা পুরস্কার পান দোলা। তার স্বামী কামাল বেপারী একটি ব্যাংকের এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে তার সাত বছরের একটি ছেলে সন্তানও আছে। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
রহিমা আরা দোলা বলেন, সন্তানের মৃত্যুর পর তিনবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। এমন অবস্থা হয়েছিল, প্রতি মুহূর্ত মনে হতো আমি কেন এখনও বেঁচে আছি। হঠাৎ একজনের পরামর্শে যুব উন্নয়ন থেকে টেইলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নিই। ছাগল বিক্রির ২০ হাজার টাকা ও তিনটি জামার ডিজাইন থেকে আমার এই ব্যবসা শুরু। এখন আমার মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত সাতজন নারী কাজ করছেন। তারা নিজের বাড়িতে বসেই সুঁই-সুতার মাধ্যমে আমার করা ডিজাইনে নকশা করে আয় করছেন। তাছাড়া আমি যুব উন্নয়নের মাধ্যমে প্রায় দেড় শতাধিক নারীকে সেলাই কাজের প্রশিক্ষণও দিয়েছি। তারা অনেকেই প্রশিক্ষণ পেয়ে আর্থিকভাবে সফল হয়েছেন।
মাদারীপুরের স্থানীয় সংগঠন জাগো উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, দোলা নিজ চেষ্টায় অল্পদিনেই স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন। তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সাড়া জাগাতে পেরেছেন।
মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক নাজনীন আফরোজ বলেন, যারা জয়িতা পুরস্কার পান, তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে একটা বাস্তব গল্প থাকে। যা দেখে বা শুনে অন্য নারীরা উৎসাহ পান। তেমনই একজন মাদারীপুর সদর উপজেলার রহিমা আরা দোলা। তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে আজ অন্য নারীরাও কাজের সুযোগ পেয়েছেন। তাই তাকে দেখে অন্য নারীরাও উৎসাহ পাবেন। রহিমা আর দোলার মতো নারীরা আমাদের সমাজের সফলতার জ্বলন্ত উদাহরণ।
এফএ/এমএস