‘যদি নিজেকে নারী হিসেবেই ভাবতাম, এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না’

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৭:১১ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৫

শাহরিয়া সুলতানা, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারোত্তোলন কোচ। প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ২৫ বছর ধরে আছেন ভারোত্তোলনের সঙ্গে। খেলোয়াড় থেকে এখন জাতীয় কোচ। লম্বা এই সময়ে নানা চড়াই-উতড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে তাকে। নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে নানান প্রতিবন্ধকতা সামলে কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপে জানিয়েছেন সে কথা।

শাহরিয়া সুলতানার ভাষ্যে তার জীবনের গল্প তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য-
নানা চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে আমি আজ এই পর্যায়ে। আমার দীর্ঘ এই পথচলা মোটেই মসৃণ ছিল না। বড় ধরনের কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হইনি কখনো। তবে ছোট ছোট বাধা কিন্তু ছিল। নিজেকে আমি নারী হিসেবে কখনো আলাদা করিনি। নারী না ভেবে নিজেকে সবসময় ক্রীড়াবিদই মনে করি। তারপরও নারী হিসেবে পুরুষ সতীর্থদের কাছ থেকে সেরকম সহানুভূতি পাইনি কখনো। বরং কটূক্তিই শুনতে হয়েছে।

আমি নড়াইলের মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। স্কুল দূরে হওয়ায় আমি বাইসাইকেল চালিয়ে যেতাম। অনেকে কটূক্তি করতেন। মেয়ে হয়ে সাইকেল কেন চালাই এমন কথাও শুনতে হয়েছে। এখন অবশ্য সেই নিষেধ নেই। মেয়েরা বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল সবই চালায়। অন্যসব জেলার চেয়ে নড়াইলের মানুষ একটি বেশি সংস্কৃতিমনা। ক্রীড়ায়ও বেশ উৎসাহী নড়াইলের মানুষ। বিশেষ করে আমার শিক্ষক বাবা। তার জন্যই আমি পরিবার থেকে বেশ উৎসাহ পেয়েছিলাম খেলাধুলা আর সংস্কৃতি চর্চা করতে। বাবা শিক্ষক ছিলেন বলে আমারও বাড়তি একটা গুরুত্ব ছিল সতীর্থদের কাছে। আমার বাবা আমাকে খেলার সামগ্রী কিনে দিতেন। আমি থ্রো ইভেন্টে বেশ পারদর্শী ছিলাম।

নড়াইলে কলেজে পড়ার সময় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি সবার চেয়ে ভালো ফলাফল করতাম। গোলক নিক্ষেপের সময় একবার আমার হাতে ফ্র্যাকশ্চার হয়েছিল। সাড়ে ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের গোলক ছিল। ওই সময় থেকে আমার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০০-২০০১ শিক্ষাবর্ষে আমি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম খেলোয়াড় কোটায়। থ্রো ইভেন্টে কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড ভেঙে আমি ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলার অনুশীলন করতে গিয়েও অনেক প্রতিবন্ধতার মুখে পড়তে হয়েছে। উড়ো চিঠিতে হুমকিও পেয়েছি। এমনকি হলের ঠিকানায় আমাকে ব্লেডও পাঠানো হয়েছে। আমি ভয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশও করতাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে অভয় দিয়েছিলেন বলেই অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছিলাম। সব ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমি খেলার সাথে লেগে ছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র ছিলেন দেশের ভারোত্তোলনের দুই পরিচিত মুখ কাজল দত্ত ও মোল্লা সাবিরা। তারাই আমাকে একদিন প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারোত্তোলনের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। আমি রাজি হয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ গেমসে কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়ে স্বর্ণ জিতেছিলাম। ওই বছরই আমি বাংলাদেশ আনসারে যোগ দিয়েছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানের খেলোয়াড় ছিলাম ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ২০০৬ সালে যোগ দেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ হিসেবে। আনসারে যোগ দেওয়ার পর নড়াইল থেকে এসেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি।

ক্রীড়াঙ্গনে আছি ক্রীড়াবিদ, কোচ হয়ে। তবে এটা বাস্তব যে, আমি নারী। নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা না করলেও নারী হওয়ার কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি যে হতে হয়নি বা হচ্ছে না, তাও নয়। এই যেমন, আমি যখন খেলাধুলা করতাম তখনে ভারোত্তোলনে কোনো নারী কোচ ছিল না। মেয়েদের অনুশীলনের শুরুতে, শেষে কিছু সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। যেগুলো পুরুষ কোচ বা পুরুষ সতীর্থদের দিয়ে সম্ভব নয়। এই কাজগুলো আমরা যে মেয়েরা অনুশীলন করতাম তারাই করে দিতেন একে অন্যকে। মেয়েদের জন্য মেয়ে কোচ হলে একটা সুবিধা তো আছে। আমরা খেলোয়াড়ী জীবনে ওই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি।

আবার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দেশের বাইরে গেলে ছেলে সতীর্থদের ইঙ্গিতপূর্ণ নানা আচরণও দেখতে হয়েছে। কৌশলে সেগুলো এড়াতে হতো। এক কথায় বিশাল একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আমাকে ক্যারিয়ার গড়তে হয়েছে। আমি যদি নিজেকে নারী হিসেবেই ভাবতাম, তাহলে নিশ্চয়ই এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না।

আমার মেয়ে যখন ছোট তখন আমাকে অফিস সামলাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পুরুষ সতীর্থদের কাছ থেকে তখন কিন্তু সেই সহানুভূতি পাইনি। বরং এমন কথাও শুনতে হয়েছে-‘নারী হয়ে চাকরি করতে এসেছি কেন?’ এসব প্রতিকূলতা ঠেলেই নিজেকে ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছি, জাতীয় কোচ হয়েছি। এখন আছি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (স্পোর্টস) হিসেবে। ২০১৭ সালে ভারোত্তোলনে সরকার আমাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান করেছে।

ক্রীড়াবিদ সে পুরুষ নাকি নারী সেটা বড় বিষয় না। সবাই দেশের জন্যই লড়াই করেন। আমাদের দেশে নারী খেলাধুলায় অনেক সাফল্য আছে। এখন ছেলেদের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে নেই। তবে নারীরা আরও সুন্দর পরিবেশ পেলে সাফল্যের পরিমাণও বাড়বে নিশ্চয়ই। নারী ও পুরুষদের মিলিত হাতই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাড়িয়ে দিতে পারবে দেশের সম্মান।

আরআই/এমএমআর/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।