আরিচা-কাজিরহাট নৌরুট

সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না স্পিডবোট

আলমগীর হোসাইন আলমগীর হোসাইন , জেলা প্রতিনিধি পাবনা
প্রকাশিত: ০৪:৪২ পিএম, ২০ মে ২০২৫
ঘাটে বাঁধা সারি সারি স্পিডবোট/ছবি-জাগো ‍নিউজ

দীর্ঘ কয়েক বছর পর পাবনার কাজিরহাট-আরিচা নৌপথ স্পিডবোটে পারাপারে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এর তোয়াক্কা করছেন না বোট মালিকরা। ২১০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পাঁচ টাকা ঘাটে প্রবেশ ফি। অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ না করারও অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে স্পিডবোটের ভাড়া ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপর আর সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। বোট পরিচালনা ব্যয় ও যাত্রীর স্বার্থ বিবেচনায় বিআইডব্লিউটিএ ও বোট মালিকরা মৌখিকভাবে নির্ধারণ করে এতদিন ভাড়া আদায় করেছেন। এরপর চলতি বছরের ৯ এপ্রিল আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে স্পিডবোটের যাত্রী ভাড়া ২১০ টাকা নির্ধারণ করে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু এ ভাড়া তোয়াক্কা করছেন না বোট মালিকরা।

সরেজমিনে কাজিরহাট ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাউন্টার থেকে ২৫০ টাকায় স্পিডবোটের টিকিট নিচ্ছেন যাত্রীরা। টিকিটেও এর মূল্যমান ২৫০ টাকা-ই লেখা রয়েছে। তবে টিকিটে বিআইডব্লিউটিএ, সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সিল নেই। কোনো কোনো যাত্রী সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কথা বললে এই ভাড়াতেই যেতে হবে বলে জানানো হচ্ছে কাউন্টার থেকে। ফলে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত টাকায় টিকিট নিচ্ছেন যাত্রীরা।

সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না স্পিডবোট

যাত্রীরা বলছেন, সাধারণ ভাড়ার তুলনায় ৪৫ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। এক বোটে ১২ জন করে যাত্রী নেওয়ার কথা রয়েছে। অথচ গাদাগাদি করে ১৮-২২ জনও নেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয় না।

পাবনা থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন আব্দুল বাতেন নামের এক যাত্রী। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘এরা সরকারকেও মানে না, সেখানে আমাদের মানবে? কাউন্টারে গেলে অতিরিক্ত কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। বলে এই ভাড়াতেই যেতে হবে। এগুলো দেখবে কে?’

ঢাকার সাভারে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শফিকুর রহমান। ঈশ্বরদী প্রজেক্ট ভিজিট শেষে সাভার ফিরছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২১০ টাকা ভাড়া বেঁধে দিয়েছে সরকার। অথচ নেওয়া হচ্ছে ২৫৫ টাকা। কাউন্টারে ২৫০ টাকা ও ঘাটে ঢুকতেই আরেকটি টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে আরও পাঁচ টাকা। অথচ যতটুকু জানি তাতে ওই ২১০ টাকার মধ্যেই ঘাটের প্রবেশ ফি রয়েছে। এভাবেই সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা উচিত।’

সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না স্পিডবোট

আরও পড়ুন:

তবে এসব অভিযোগের বিপরীতে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন বোট চালক ও মালিকদের। তারা বলছেন, প্রতি ট্রিপে একটি বোটের পেছনে ব্যয় রয়েছে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় লোকসানে পড়বেন তারা।

কথা হয় শফিক ও শামীম নামের দুই স্পিডবোট চালকের সঙ্গে। তারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক ট্রিপে ২২ লিটার তেল লাগে। সে হিসেবে ২৭০০-২৯০০ টাকার তেল লাগে। সঙ্গে চালক ও ঘাট খরচ আছে। তাতে এসব খরচ মিটিয়ে মালিকদের কিছুই থাকে না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় স্পিডবোট চালালে মালিকরা লোকসানে পড়বেন। বোট চালাতে পারবেন না।’

সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না স্পিডবোট

লাইফ জ্যাকেট ও অতিরিক্ত যাত্রীর প্রশ্নে তারা বলেন, ‘লাইফ জ্যাকেট দিলেও যাত্রীরা পরে না। গরমের জন্য খুলে ফেলে। বড় বোটে যাত্রী বেশি নেওয়া যায়। এজন্য দু-একজন বেশি নেওয়া হয় কখনো।’

বোট মালিক সমিতির সভাপতি রইস উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই ২৫০ টাকা ভাড়া-ই নেওয়া হয়। ওইভাবেই নেওয়া হচ্ছিল। তবে সপ্তাহ দুয়েক আগে নতুন ভাড়ার প্রজ্ঞাপন হয়েছে। কম হলেও ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। ব্যস্ততায় আমি বাইরে থাকার কারণে এটি করা হয়নি। ফিরে দ্রুতই ভাড়া আদায়ের বিষয়টি সমন্বয় করা হবে।’

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ে ৫৪ টি বোটের রুট পারমিট দেওয়া হয়। পরে কয়েকটি ধাপে আরও বেশ কিছু বোটকে রুট পারমিট দেওয়ার পর আরিচা ও কাজিরহাট দুই পাড়ে এখন মোট ১৪২টি স্পিডবোট চলাচল করছে।

অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর নগরবাড়ি-কাজীরহাট ঘাট কার্যালয়ের পোর্ট অফিসার আব্দুল ওয়াকিল।

সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না স্পিডবোট

তিনি বলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক আগে এই রুটে ২১০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। আমরা এরইমধ্যে বোট মালিকদের সঙ্গে নতুন ভাড়া আদায় ও অন্যান্য নিয়ম পালনের বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু তারা সেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এখনো অব্যাহত রেখেছেন। আমরা আবার তাদের সঙ্গে কথা বলবো। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান চালাবো। এরপরও যদি তারা নির্দেশ না মানেন তাহলে প্রয়োজনে তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। ঈদযাত্রা শুরুর আগেই আমরা এটির একটি সমাধান করবো।’

ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে ২০১৬ সালের দিকে কাজিরহাট-আরিচা নৌরুটে লঞ্চ ও ফেরির পাশাপাশি স্পিডবোট চলাচল শুরু হয়। সাধারণত ১৩ ও গ্রীষ্মকালে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরত্বের এই নৌপথে চারটি ফেরি ও ৯টি লঞ্চ চলাচল করে। বর্তমানে দুই পাড়ে (আরিচা ও কাজিরহাট) ১২ সিটের ১৪২টি স্পিডবোট চলাচল করে। এতে এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের জলপথ পাড়ি দেওয়া যায় ১৫-২০ মিনিটে। এ কারণে প্রতিদিন হাজারেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করেন স্পিডবোটে। ঈদের সময়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন।

সড়কপথে ঢাকার সাথে পাবনার দূরত্ব ৫-৬ ঘন্টার। যানজটের কবলে পড়লে কখনো লেগে যায় ৮-১২ ঘণ্টা। সেখানে কাজিরহাট-আরিচা নৌপথে ঢাকা যেতে সময় লাগে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা।

পাবনার বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোরশেদুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন আগেও আমরা অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। কিন্তু এতেও এ অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। অভিযানে গেলে দুই পাড় থেকেই বোট চালানো বন্ধ করে দেয়। এরপরও আমরা তৎপর রয়েছি। বিআইডব্লিউটিএ সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই তা করা হবে।

এএইচআইএন/এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।