গাইবান্ধা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র
‘ডাক্তারও নাই ওষুধও নাই, হামরা কি বিনা চিকিৎসায় মরি যামো?’
‘কয়েকদিন থাকি সর্দি-জ্বরে পড়ি কাহিল হয়া (হয়ে) বিছনায় পড়ি। কোনোমতে হাসপাতালোত আসনু (এলাম) ডাক্তার দ্যাখে (দেখিয়ে) ওষুধ নেইম (নেই)। আসিয়া শোনোং (শুনি), ডাক্তারও নাই, ওষুধও বলে নাই। খালি হাতে ফিরি আসনো (এলাম)। হামরা (আমরা) কি বিনা চিকিৎসায় মরি যামো?’
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে এসে না পেয়ে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের মরুয়াদহ গ্রামের বাসিন্দা ছালেয়া বেওয়া (৬৫)।

তবে এ চিত্র শুধু ছাপরহাটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের নয়, জেলার প্রায় সব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাইবান্ধায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে এক বছর ধরে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ নেই। ফলে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, অন্তঃসত্ত্বা মা ও জন্মনিরোধ কপাটি, ইমপ্ল্যান্ট, ভ্যাসেকটমি, টিউবিকটমি কার্যক্রম ও সাধারণ চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। সেবা নিতে যাওয়া রোগীদের শুধু ব্যবস্থাপত্র হাতে ধরে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে জনসাধারণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলার ৮২টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার মোট জনসংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। ৮২টি ইউনিয়নের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৬৮টি। জেলার কেন্দ্রগুলোতে ৯৭৫ জন জনবলের বিপরীতে কর্মরত ৬০০ জন। অনেক কেন্দ্রে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। ১৩ জন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র একজন। তিনি জেলা শহরের মাতৃসদন হাসপাতালে বসেন। এতে করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থাকলেও মিলছে না আশানুরূপ সেবা। কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে সেবা না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে সাধারণ লোকজনকে। এসব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ নেই। চিকিৎসক ও জনবল সংকটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আরও পড়ুন
একমাত্র জনবল একজন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান সপ্তাহে একদিন
‘সারাদিন মানুষের ক্ষোভের কথা শুনছি, ওরস্যালাইনও নেই যে দেবো’
কর্মীদের বেতন বন্ধ ৭ মাস, কবে পাবেন জানেন না কেউ
সরেজমিনে জেলার অনন্ত ১০টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, গর্ভবতী মা ও শিশুরা স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রে পরামর্শ ও ওষুধ নেওয়ার জন্য আসছেন। কোনো কোনো কেন্দ্রে শুধু অফিস সহকারী বসে আছেন। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার থাকলেও রোগীদের হাতে শুধু ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না।
কেন্দ্রগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চালু রাখার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র উল্টো। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো সকাল ১০টার পর খোলা হয় এবং দুপুর দেড়টার পরই বন্ধ হয়ে যায়।

ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওষুধ সরবরাহ না থাকায় খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য আসে। তাদের ওষুধ না দিলে ব্যবস্থাপত্র নিতে চায় না।’
গোবিন্দগঞ্জের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের একজন ভিজিটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওষুধ ছাড়া রোগী পরামর্শ নিতে আগ্রহী নয়। কোনো রোগী আসছে না। ফলে জন্মনিরোধ কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। এতে জন্মহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছিলেন চন্দনা রানী ( ৪২)। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক দিন ঘুরেও কোনো ডাক্তার বা ওষুধ পাইনি। আসি আর ঘুরে ঘুরে যাই।’
বসে মোবাইলে গান শুনছিলেন একই কেন্দ্রের অফিস সহকারী আশরাফুল ইসলাম। কেন্দ্রের বাকি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ছোট চাকরি করি। কে কোথায় যায় আমাক কি বলে যায়? আমি কোনো কথা বলতে পারবো না।’

নাম প্রকাশ না করে বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ওষুধ নেই। রোগীরা এসে গালমন্দ করেন, বিষয়টি খারাপ লাগে। আমরা উপজেলার কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। তারা বলেছেন, যা আছে সেটা দিয়েই চিকিৎসা দেন। না থাকলে পরামর্শ দেন।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. মো. তারিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেন্দ্রগুলোতে জনবল সংকট রয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে কোনো ওষুধ নেই। আমরা প্রতি মাসেই চাহিদা পাঠাচ্ছি। তবে আগামী মাস থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে বলে ধারণা করছি।’
এসআর/জিকেএস