ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেলো টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি
টাঙ্গাইলের শত বছরের ঐতিহ্যে বোনা টাঙ্গাইল শাড়ি এবার জায়গা করে নিয়েছে ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির মনোনয়ন তালিকায়। এ খবরে তাঁত ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দ। তবে এখনো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি খবর জানে না তাঁত শ্রমিকরা। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেলেও তাঁতিদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। আন্তর্জাতিক এ স্বীকৃতি যেমন গর্বের, তেমনি রয়েছে শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখার বড় চ্যালেঞ্জও।
জানা যায়, শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে এখানকার তাঁত শিল্প। রঙিন সিল্ক আর কটন থ্রেডে দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। শাড়ির সুতা রঙের কাজ ও নকশা তৈরির কাজ করেন পুরুষ তাঁতিরা। আর চরকিতে সুতা কাটায় সহায়তা করে নারীরা। একটি শাড়ি তৈরি হয় দিনের পর দিন শ্রম, নকশা আর নৈপুণ্যের সমন্বয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। বাড়ছে কাঁচামালের দাম, সস্তা মেশিনে বোনা শাড়ির ভিড়ে কমছে চাহিদা। পেশা বদলে অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন অনেক তাঁতি। টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী বলা হয় পাথরাইলকে। এ পাথরাইলসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বছরের পর বছর তাঁত শ্রমিকদের কোন ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। মজুরি কম পাওয়ায় হতাশ তাঁতিরা। অপরদিকে পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। যার ফলেও প্রভাব পড়েছে শাড়িতে।
নারীদের উৎসবের পোশাক মানেই শাড়ি। যে কোনো অনুষ্ঠানে আবহমান বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। এর মধ্যে আবার তাদের টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা টান। বিশেষ করে ঈদ, পূর্জা ও বৈশাখীতে প্রচুর চাহিদা থাকে।

সরেজমিনে তাঁত শাড়ির রাজধানী দেলদুয়ার উপজেলার রাজধানীতে দেখা যায় খটখট শব্দে মুখর তাঁত পল্লি। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছে। তবে আগের তুলনায় তাঁতের সংখ্যা কমেছে। অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁত।
তাঁতিরা বলেন, অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। অন্য কাজ জানেন না, তাই বাধ্য হয়ে এ পেশায় রয়েছেন। মালিকরা লাভবান হলেও আমরা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে লাভবান হচ্ছি না। একটি শাড়ি তৈরি করলে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এতে সংসার চালানোও মুশকিল।
ছালেক নামের এক তাঁতি বলেন, আমি ১৩ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত। আগের থেকে তাঁত শাড়ির চাহিদা কমেছে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। স্বীকৃতির ব্যাপারে আমারে কেউ কোনো কিছু বলেনি।
তিনি বলেন, আমাদের এ পেশায় আয় খুবই কম। মালিক পক্ষ লাভবান হলেও আমাদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি।
আরও পড়ুন
মণিপুরী শাড়ি বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়
মজুরি কম, ঈদেও নেই বোনাস
ক্রেতার অপেক্ষায় তাঁতপল্লি
তাঁতি মো. আরিফ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় আগে অনেক তাঁত ছিল। কিন্তু পাওয়ার লোমের কারণে হ্যান্ডলোমের তাঁতের সংখ্যা কমেছে। পাওয়ারলোমের চেয়ে হাতে বোনার শাড়ি অনেক ভালো এবং টেকসই অনেক।

৩৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত শহিদুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, একপিস শাড়ি তৈরি করলে ৪ থেকে ৫শ’ টাকা পাওয়া যায়। সপ্তাহে আমরা ৭ থেকে ৯ পিস শাড়ি তৈরি করতে পারি। আমাদের এ মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার ঠিকমতো চলে না। তবুও বংশপরম্পরায় এ পেশায় আমরা টিকে রয়েছি।
তিনি বলেন, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। মালিকপক্ষ আমাদের কোনো কিছুই বলেনি। তাঁত শাড়ির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাছেদ আলী শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ৩৭ বছর ধরে তাঁত শাড়ি তৈরি করছি। আমাদের এখানে ১৮ টি তাঁত শাড়ির মেশিন রয়েছে। আগের তুলনায় বিক্রি খুব কম হচ্ছে। আমরা কোনোমতে এ পেশায় টিকে রয়েছি।
তাঁত মালিকরা বলেন, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এ শিল্পকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। সরকারি সহায়তা বাড়ানো গেলে শিল্প আবারও ফিরে পাবে তার প্রাচীন জৌলুস। তবে এখনো টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারতের নামে রয়েছে। জিআই সত্ত্ব টাঙ্গাইলের নামে হলে আমরা আরও আনন্দিত হতাম।
তাঁত ব্যবসায়ী খোকন বসাক জাগো নিউজকে বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা খুশি। এর ফলে সারা বিশ্বের মানুষ টাঙ্গাইল শাড়ির সম্পর্কে জানতে পারলো। আশা করছি এর সুবিধা আমরা সারা বিশ্বে পাবো। এ সম্মান আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে শাড়ির ব্যবসা খুব একটা ভালো না। কারণে শাড়ি পরার সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। সরকারি আইন থাকলে হস্তচালিত তাঁতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতো। গত এক বছরে অনেক তাঁতির সংখ্যা কমেছে। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারতের নামে রয়েছে। জিআই সত্ত্ব টাঙ্গাইলের নামে হলে আমরা আরও আনন্দিত হতাম।
আরেক ব্যবসায়ী তপু বসাক জাগো নিউজকে বলেন, দিনদিন তাঁতির সংখ্যা কমছে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ফলে আশা করছি এর জৌলুস পুরোদমে আবারও ফিরে পাবে। স্বীকৃতির ফলে টাঙ্গাইল শাড়ির নাম জানতে পারলো সারা বিশ্ব।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক জাগো নিউজকে বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি ইউনেস্কোর তালিকায় গেলে বিশ্বে সুনাম বাড়বে। তৈরি হবে নতুন বাজার। এর ফলে নতুনভাবে ঘুর দাঁড়ানোর আশা করছি। তবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সম্পর্কে ধারণে নেই প্রান্তিক তাঁতিদের। আশা করছি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তাঁতিদের ইউনেস্কোর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল শাড়ি ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে সদ্য অন্তর্ভুক্ত হয়। ৯ ডিসেম্বর ভারতের নয়াদিল্লীতে চলমান ইউনেস্কোর ২০তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আব্দুল্লাহ আল নোমান/আরএইচ/জেআইএম