পাটকাঠির ছাই আনছে বৈদেশিক মুদ্রা

ফরিদপুরের বোয়ালমারী, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও সালথা উপজেলায় একাধিক কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। ওই এলাকার পাটকাঠি পোড়ানো ছাইয়ের কার্বন এতদিন চীনে রপ্তানি হলেও চীনের বাইরে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, তাইওয়ানসহ আরও কিছু দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে পাটের মন্দা ভাবের পর আবার সুদিন ফিরে আসছে। কাঁচাপাট রপ্তানির পাশাপাশি পাটজাত বিভিন্ন দ্রব্যও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই মুহূর্তে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
তবে এখন শুধু পাট আর পাটজাত দ্রব্যই নয় সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে পাটকাঠির ছাই। ওই ছাই থেকে তৈরি হয় কার্বন। পাটকাঠি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে পাউডার। যা কার্বন নামেও পরিচিত। এই কালো কার্বন চিনসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আর এই কার্বন থেকে তৈরি করা হচ্ছে, কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, বাহারি রঙের আতশবাজি, মোবাইলের ব্যাটারি ও প্রসাধনীপণ্য ইত্যাদি।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগর এলাকায় গড়ে উঠেছে দুইটি পাটকাঠির কার্বন ফ্যাক্টরি। একটি গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরি অপরটির নাম কে এইচ কার্বন ফ্যাক্টরি। ময়না ইউনিয়নের মধুমতির পাড় এলাকায় রুইজানি গ্রামে গড়ে উঠেছে আরও একটি কার্বন ফ্যাক্টরি।
সরজমিনে এসব ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখা যায়, ফ্যাক্টরিগুলো উৎপাদনমুখী। ফ্যাক্টরিগুলোতে কার্বন উৎপাদনের কাঁচামাল হাজার হাজার মণ পাটকাঠি মজুত করা হয়েছে। পাটকাঠির ওপর মূলত নির্ভর করে ফ্যাক্টরি চালু থাকা। সে অনুযায়ী ছয় মাস চালু থাকে এসব কলকারখানাগুলো। জুলাই ও আগস্ট মাস থেকে পাটকাঠি ওঠা শুরু হয়। পাটকাঠি ওঠার পর অক্টোবর থেকে মার্চ ও এপ্রিল পর্যন্ত মিলগুলির উৎপাদন কার্যক্রম চালু থাকে। বাকি মাসগুলো বন্ধ অবস্থায় আবার পাটকাঠির অপেক্ষায় থাকতে হয় মিল মালিকদের।
বোয়ালমারীর জয়নগরে অবস্থিত গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরির মালিক হীরু মুন্সি জাগো নিউজকে বলেন,
ফরিদপুর জেলায় প্রচুর পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়। আমাদের কলকারখানায় কার্বনের কাঁচামাল হিসেবে প্রয়োজন এই পাটকাঠি। এ এলাকায় পাটকাঠি ও শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ায় এ অঞ্চল কার্বন ফ্যাক্টরির জন্য বেশ উপযোগী।
এর পাশেই গড়ে ওঠা আরেকটি কার্বন ফ্যাক্টরি কেএইচ কার্বন। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন ২০১৬ সালে ফ্যাক্টরিটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ফ্যাক্টরির দায়িত্বরত মো. সবুজ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ছয় মাস মিলটি চালু থাকে। প্রতিদিন চারশ মণ পাটকাঠি প্রয়োজন হয়। প্রতি মণ পাটকাঠি থেকে প্রায় ১০ কেজি চারকাল পাউডার বা কার্বন উৎপাদন হয়। প্রতি কজি কার্বন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। পাটকাঠি ২২০ টাকা থেকে ২৩০ টাকা মণ দরে কিনতে হয়। ফ্যাক্টরিতে ২০ জন লোক কাজ করেন বলে তিনি জানান।
ইমপিগনা প্রাইভট লি.এর কারখানার ম্যানেজার মো. খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ৯৫ ভাগ ছাইয়ের কার্বন পাউডার রপ্তানি করা হয় চীনে। বাকি ৫ ভাগ অন্যান্য দেশে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, বিদেশিরা কার্বন থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনীপণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও খেতের সারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন।
খোরশেদ আলম আরও বলেন, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি চালানে প্রায় ৮ কন্টেইনার বা সাড়ে ১২ কেজির ৬ হাজার বস্তা কার্বন উৎপাদন করা হয়। এই পরিমাণ কার্বন উৎপাদনে পাটকাঠি লাগে প্রায় ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার মণ। প্রতি কজি পাটকাঠি থেকে এক কেজি কার্বন উৎপাদন হয়। প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা তাদের লাভ থাকে।
মধুখালীর জিনসিং ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড কার্বন ফ্যাক্টরির মালিক চীনা নাগরিক ওয়াং চুয়াং লি। ২০১৩ সালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন উপজেলার দিঘলিয়ায় ফ্যাক্টরি স্থাপনের পর ১৮টি চুল্লির মাধ্যমে পাঠকাঠি পুড়িয়ে কার্বন তৈরি করা হয়।
ফ্যাক্টরিটির ম্যানেজার আব্দুর রহিম জাগো নিউজকে বলেন, শুরু থেকেই আমি এখানে দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিদিন ৩০ টন পাঠকাঠির প্রয়োজন হয়। ভালোই চলছিল, কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা মন্দা।
পাটকাঠি বিক্রেতা মো. আলম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে পাটকাঠি কিনে মিলগুলোতে বিক্রি করি। প্রতি মণ পাটকাঠি আড়াইশ টাকা দরে বর্তমানে বিক্রি করছি।
তিনি আরও বলেন, একসময় পাটকাঠি শুধু রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন এই কারখানা হওয়ায় পাটকাঠির বেশ চাহিদা বেড়েছে।
কার্বন ফ্যাক্টরি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকাল ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিসিএমইএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চারকাল রপ্তানি হয় চার হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন। প্রতি টনের মূল্য ছিল ৭০০ ডলার। এ হিসাবে চারকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার বা প্রায় ২৪ কোটি ৮০ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে মধুখালী পৌরসভার মেয়র খন্দকার মোরশেদ রহমান লিমন জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুরে কার্বন ফ্যাক্টরিগুলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয় আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে। এখন পাটকাঠি বিক্রি করে কৃষক টাকা পাচ্ছেন। পাশাপাশি অনেকে ব্যাবসা করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এ কারণে বেকার সমস্যাও হ্রাস পাচ্ছে।
এফএ/এমএস