এক সড়কে ২০ বছরে আট স্বজন হারিয়েছে শিশুটি
বাড়ির আঙিনায় নতুন তিনটি কবর। কবরগুলো বৃদ্ধা সুফিয়া বেগমের একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৪০), অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ রত্না বেগম (৩০) ও নাতনী সানজিদার (৬)। দুদিন ধরে কবরের পাশে বসেই বিলাপ করছেন তিনি। পাশেই বসে আছে বাবা, মা ও বোন হারানো অপর দুই সন্তান এবাদত মিয়া (৮) ও জান্নাত আক্তার (১০)। ঘটনায় স্তব্ধ এলাকাবাসী। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই।
রোববার (১৭ জুলাই) ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রায়মণি এলাকায় ট্রাকচাপায় স্ত্রী-সন্তানসহ নিহত জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়।
জানা গেছে, গত ২০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীর আলমসহ তার পরিবারের ৮ জনের প্রাণ গেছে। এরই মধ্যে ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেট ফেটে নবজাতক জন্মের ঘটনাকে অলৌকিক বলছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, ওই সড়কে আমার দুই ছেলে, নাতনি, পুত্রবধূ, আমার এক ভাই ও তিন মামাসহ মোট ৮ জন মারা গেছেন।
তিনি বলেন, বাড়ির সামনের কবরস্থানে আমার মা, এক ভাই, দুই ছেলে, দুই নাতি-নাতনি ও পুত্রবধূসহ ৭ জনের কবর আছে।
জাহাঙ্গীর আলমের ফুপু হেলেনা বেগম আক্তার বলেন, এই তিনজনসহ ওই সড়কে গত ২০ বছরে আমাদের পরিবারের ৮ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তবে আজও পর্যন্ত কোনো বিচার পেলাম না। সঠিক বিচার পেলে হয়তো বারবার এমন ঘটনা ঘটতো না। এবারের ঘটনায় আমরা দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
নিহত জাহাঙ্গীরের বোন মমতাজ আক্তার বলেন, আমার ভাবি ১০ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঈদের আগেই সন্তান জন্মের কথা ছিল। তবে হয়নি। কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানার জন্য ত্রিশালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাতিজি আর ভাই-ভাবি আর ফিরলেন না। অবুঝ শিশুগুলোকে যে এতিম করেছে তার কঠিন বিচার চাই।
জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, আমার এক মাত্র ছেলে ছিল জাহাঙ্গীর। ওই নবজাতকসহ জাহাঙ্গীরের তিন ছেলে মেয়ে জীবিত রয়েছে। তিন জনের মাঝে ছেলেটা কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আমি গরিব মানুষ, ছোট একটা চায়ের দোকান করে আমার সংসার চলে। ওই তিন সন্তানকে কিভাবে লালন পালন করবো বুঝতে পারছি না। সরকার যদি আমাকে সহায়তা না করে তাহলে ওদের নিয়ে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য কঠিন।
এদিকে এলাকার আনিস মিয়া বলেন, জাহাঙ্গীর শ্রমিকের কাজ করতেন। শনিবার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্নাকে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে ত্রিশালে যান। এ সময় তার সঙ্গে যায় মেয়ে সানজিদাও। সেখানে গিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় তিনজনই মারা যান। তবে ট্রাকচাপায় মায়ের পেট ফেটে বাচ্চা জন্ম নেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন ও অলৌকিক। দোয়া করি শিশু যেন বেঁচে থাকে।
ত্রিশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এই ঘটনার পর নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো অভিযোগ বা মামলা করতে কেউ আসেনি। তবে ট্রাকটি থানা হেফাজতে আছে।
জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেন, খবর পেয়ে আমি ওই বাচ্চাটিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাাম। বাচ্চার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ ও ভবিষ্যতে যেন তার কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য তার নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট করে দেওয়া হবে।
শনিবার (১৬ জুন) দুপুরের পর উপজেলার রাইমনি গ্রামের ফকির বাড়ির মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৪০) তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (৩০) ও মেয়ে সানজিদাকে (৬) নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে ত্রিশালে যান। পৌর শহরের খান ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই জাহাঙ্গীর আলম ও স্ত্রী রত্না বেগম মারা যান এবং মেয়ে সানজিদা আক্তার গুরুতর আহত হয়। এসময় ট্রাকচাপায় রত্না বেগমের পেট ফেটে কন্যাশিশুর জন্ম হয়।
পরে আহত সানজিদা ও নবজাতককে নিয়ে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সানজিদাকে মৃত ঘোষণা করে নবজাতকটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। তবে অতিরিক্ত যানজটের কারণে নবজাতককে চুরখাই কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে চিকিৎসা দিয়ে ময়মনসিংহ মহনগরীর চরপাড়া এলাকায় লাবিব হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শনিবার রাতেই জানাজা শেষে উপজেলার রায়মণি এলাকার নিজ বাড়িতে পাশাপাশি তাদের দাফন করা হয়।
এফএ/জেআইএম