প্রবাহমান খাল আটকে মাছ চাষ, হুমকিতে নীলগঞ্জের কৃষি
অডিও শুনুন
আধুনিক কৃষিতে সমৃদ্ধ এক জনপথ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে ব্যবহার করেন পাখিমারা খাল। তবে সম্প্রতি প্রবাহমান এই খালে জাল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে প্রভাবশালী একটি মহল মাছ চাষ শুরু করেছে। ফলে খালে নৌচলাচল বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার কয়েকশো কৃষক। উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করাসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
এমতাবস্থায় খাল বন্ধ করার বিষয়ে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিবাদ জানালে তাদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসক ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারা খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার আর প্রশস্ত প্রায় ৫০০ ফুট। এই খালকে কেন্দ্র করেই আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে আধুনিক কৃষির বিশাল এক ক্ষেত্র। এখানকার কৃষকরা সারাবছরই আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করেন। কৃষকরা বর্ষা মৌসুমেও সবজি চাষের জন্য বেছে নিয়েছেন পলিনেট ও মালচিং পেপারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি। এর ফলে গ্রীষ্মকালীন টমেটো, গাজর, মরিচ, বোম্বাই মরিচ, তরমুজ, রেড বিটসহ বিভিন্ন ফসল তারা অসময়ে উৎপাদন করতে পারছেন।
আর এসব ফসল ফলাতে গিয়ে সারসহ বিভিন্ন কৃষি সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি পরিবহন এবং উৎপাদন পরবর্তী ফসল বাজারে পরিবহনের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। কারণ এসব কৃষি জমির পাশেই ছোট-ছোট খাল প্রবাহমান করা হয়েছে যা গিয়ে মিশেছে পাখিমারা খালে। ফলে কৃষকরা মাঠ থেকে ফসল তুলে সরাসরি নৌকায় করে স্থানীয় পাখিমারা বাজারে নিতে পারেন। এতে করে তাদের পরিবহন ব্যয় খুব কম হয়। তবে সম্প্রতি সোনার বাংলা মৎস্য সমবায় সমিতির নামে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপ জলমহাল ইজারা নিয়ে খালের দুই পাড়ে বাঁশ ও জাল দিয়ে নৌচলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন এই এলাকার কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষক প্রতিনিধি জাকির হোসেন বলেন, এক দশক আগেও এই এলাকার মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে যেত। এছাড়া এলাকায় অভাব থাকায় চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ছিল নিত্যদিনের। কিন্তু আধুনিক কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় সবাই এখন স্বাবলম্বী। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে খালকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থা। এখন সবাই সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। আর এই খাল দিয়েই যাবতীয় মালামাল পরিবহন কিংবা কৃষিপণ্য পরিবহন করতে পারতাম। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মাটির রাস্তা দিয়ে সবজি পরিবহন করে বাজারে নিয়ে উৎপাদনের থেকে বেশি খরচ হয়। গত সপ্তাহে ২০টি লাউ শ্রমিক দিয়ে মাথায় করে বাজারে নিতে ৩০০ টাকা খরচ হয়েছে। আর ওই লাউ বিক্রি করেছি এক হাজার টাকায়। যদি খাল দিয়ে নৌকায় আগের মতো চলাচল করত পারতাম তবে খরচ হতো সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন শত শত কৃষকের হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এছাড়া জাল দেওয়ার কারণে এসব জালে শেওলা ধরে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে আমাদের কৃষি শেষ। আমরা এর প্রতিকার চাই।
এদিকে, প্রবাহমান খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মাছ চাষের নিয়ম না থাকলেও অনেকটা জোর করেই খালের নৌচলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী খালপাড়ের বাসিন্দাদের মাছ চাষে সম্পৃক্ত করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনার বাংলা মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসাইন বলেন, নৌযান চলাচল করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে জাল দিয়ে খাল আটকে মাছ চাষ করার নিয়ম নেই তার পরও কেন জাল দিয়ে আটকে দিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, মূলত জলমহাল ইজারা নেওয়ার কারণে এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আমি ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। কোনো অবস্থাতেই প্রবাহমান খালে জাল দিয়ে বন্ধ করে মাছ চাষের সুযোগ নেই। এসব জাল অপসারণের বিষয়ে এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি।
এদিকে, সোনার বাংলা মৎস্য সমবায় সমিতি এক লাখ ১০ হাজার টাকায় খাল ইজারা নিলেও নীলগঞ্জ ইউনিয়নের এই খালপাড়ের কৃষকরা প্রতিবছর যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন তা প্রায় শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে জানান কৃষকরা।
আব্দুস সালাম আরিফ/এমআরআর/এএসএম