কক্সবাজারে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০১:৫৫ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২৩
পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটিচাপা পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার দৃশ্য

মামলাসহ নিয়মিত অভিযান চালিয়েও কক্সবাজারে থামছে না পাহাড় কাটা। উল্টো বছরজুড়েই প্রভাবশালীরা পাল্লা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন পাহাড় ধ্বংসযজ্ঞ। সবশেষ বুধবার (২৯ মার্চ) পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটিচাপায় উখিয়ায় তিন রোহিঙ্গা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

নিহতরা হলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১-ওয়েস্ট সি-১৪ এর বাসিন্দা আব্দুল মোতালেবের ছেলে জাহিদ হোসেন (২৩), ১৯ নম্বর ক্যাম্পের ১-ওয়েস্ট ব্লক-বি-৭ এর বাসিন্দা মোহাম্মদ ওয়ারেসের ছেলে ছৈয়দ আকবর (২০) ও ক্যাম্প-১৭ এর ব্লক-এইচ এর সুলতান আহমদের ছেলে নুরুল কবির (৩০)।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের বরাতে পুলিশ জানায়, মুহুরীপাড়া এলাকার নেছার আহমদের বাড়ির পাহাড় কেটে সমতল করার কাজ করছিলেন একদল রোহিঙ্গা শ্রমিক। একপর্যায়ে ওপরে থাকা নেছার আহমেদের বাড়ির আঙিনার অংশের পাহাড় ধসে পড়লে কর্মরত তিন শ্রমিক চাপা পড়েন

খবর পেয়ে স্থানীয়রা একজনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। ততক্ষণে তিনি নিথর হয়ে যান। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মাটির নিচ থেকে আরও দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে।

উখিয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন ইনচার্জ এমদাদুল হক বলেন, দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করার পর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ছৈয়দ আকবরের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

নিহত ছৈয়দ আকবরের মা রাবেয়া বসরী জানান, মঙ্গলবার কাজের সন্ধানে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেলে এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, শুধু উখিয়ার মুহুরীপাড়া নয়, উপজেলার পাইন্যাশিয়া, ফলিয়াপাড়া, ইনানী, পাটুয়ারটেক, নিদানিয়া, সোনারপাড়া, চোয়াংখালী, মোহাম্মদ শফির বিল, মনখালী, থাইংখালী, বাঘ ঘোনা, পালংখালী, ভালুকিয়া, হলদিয়া, হাতির ঘোনা, লম্বাশিয়া, লম্বা ঘোনা, মধুরছাড়া, মাছকারিয়াসহ পাঁচটি ইউনিয়নের ৩০টির বেশি স্থানে পাহাড় কাটা চলছে।

দেখা যায়, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, ইসলামপুর, বাঁচামিয়ার ঘোনা, ইসুলু ঘোনা, বৈদ্য ঘোনা, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশা ঘোনা, ফাতের ঘোনা, ঘোনার পাড়া, লাইট হাউস পাড়া, কলাতলী, বাইপাস সড়কের দুইপাশ, নতুন জেলা কারাগার সংলগ্ন এলাকা, নতুন পুলিশ লাইন সংলগ্ন এলাকা, লারপাড়া, উত্তরণ এলাকা, হাজী পাড়া, সদর উপজেলার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে, পল্লান পাড়া, সমিতি বাজার, দক্ষিণ রুমালিয়ার ছড়া, চকরিয়া, রামু, ঈদগাঁওসহ পুরো জেলার পাহাড় বেষ্টিত এলাকা জুড়েই চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে অসংখ্য বসতি গড়ে উঠছে। সব দেখেও যেন অসহায় প্রশাসন।

সূত্র মতে, রাতের আঁধারে প্রভাবশালী মহল শ্রমিক দিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করে। পরে দিনের বেলায় তৈরি করে বাড়ি। পাহাড় কাটা রোধে প্রশাসনের তদারকি থাকলেও ‘চোর-পুলিশ’ খেলায় জেলাজুড়ে কৌশল অবলম্বন করে পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে।

স্থানীয়রা জানান, একসময় পাহাড় কেটে মাটি মজুত করে রাখা হতো। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো মাটি। এতে শহর-গ্রামের নিচু এলাকার সড়ক ও নালা ভরাট হয়ে পড়ে। নিচু এলাকার লোকজন বিভিন্ন ক্ষতিসহ নানা দুর্ভোগের শিকার হন। তবে এখন বর্ষাকালের প্রতীক্ষা থাকে না, বছরজুড়েই পাহাড় কাটা চলে জেলাজুড়ে।

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনের নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প গড়ার পর থেকে জেলায় নির্বিচারে পাহাড় কাটা চলছে। দেশীয় লোকজন পাহাড় কাটছে জেনে বনবিভাগ ও প্রশাসন অভিযানে গেলে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হাজার একর পাহাড় কাটার বিষয়টি তুলে ধরেন সুবিধাবাদী পাহাড় দখলকারীরা। তারা বলেন, ‘হাজার হাজার একর পাহাড় ন্যাড়া করে কেটে ভিনদেশীদের আশ্রয় দেওয়া গেলে আমরা দেশের জনগণ মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পাহাড় কাটলে দোষ কী?’

তারা আরও জানান, এমন সব অজুহাতে কক্সবাজারের ৫০০ এর বেশি স্থানে বছরজুড়ে পাহাড় কাটা চলছে। এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে অর্ধসহস্রাধিক ডাম্প ট্রাক। পাহাড় কাটার ভয়াবহতা দেখলে মনে হবে, এসব বন্ধে প্রশাসন নেই। তাই, পৃথিবীর পেরেক খ্যাত পাহাড় কাটা বন্ধে যৌথ অভিযান দাবি করেন পরিবেশবিদরা।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারওয়ার আলম বলেন, বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটার খবর আসলে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হয়। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে সবসময় অভিযান করা দুরূহ হয়ে পড়ে।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বনের উপকারভোগীরাও বন এবং পাহাড় নিধনে সহায়তা করে বলে অভিযোগ আসে। তখনই তৎপরতা চালিয়ে ঘটনার সত্যতা মিললে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমন অনেক নজির থাকলেও মানুষের নৈতিকতা নষ্ট হওয়ায় অপরাধ থামে না।

তিনি আরও বলেন, পাহাড় খেকোদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। কিন্তু নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনতা সোচ্চার না হলে পাহাড় ও বন রক্ষা বনকর্মীদের একার পক্ষে অসম্ভব।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।