দারিয়ালে দেড়শ বছরের পুরোনো ঘুড়ি মেলা

প্রতিযোগিতা আকাশ ছোঁয়ার। নানা-আকৃতি ও রঙের ঘুড়িরা যেন বাতাসের কোলে দুলছে। কার ঘুড়ি কত উঁচুতে উড়ে তারই ঠাণ্ডা লড়াই চলছে বগুড়ার দেড়শ বছর পুরোনো দারিয়াল নিশান মেলায়।
বগুড়া শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে নুনগোলা ইউনিয়নের দারিয়াল গ্রামে শত বছর ধরে এ মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার থেকে শুরু হয়ে এ মেলা চলবে তিন দিনব্যাপী।
জনশ্রুতি আছে প্রায় দেড়শ বছর আগে এ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা বাঁশের মাথায় লাল গামছা ও মাথার চুল উড়িয়ে উৎসব পালন করতেন। সে থেকে এ মেলা প্রথমে নিশান ও পরবর্তীতে এলাকার নাম অনুসারে দারিয়াল মেলা হিসেবে নামকরণ হয়৷
আশপাশের গ্রামগুলোত বটেই বগুড়া শহর অঞ্চলের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবার কাছেই এ মেলার প্রধান আকর্ষণ নানা রঙের ঘুড়ি। প্রায় দশ রকমের ঘুড়ি পাওয়া যায় এ মেলায়। ফসকে, গুড্ডি, ঘুড়ি, বিমান গুড্ডি ও কয়েক রকমের চং৷ আর এ সবগুলো ঘুড়ির দাম ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও ঘুড়ি উড়ানোর নাটাই ও সুতা বিক্রি হচ্ছে মেলায় ৪৫ টাকা দামে।
আরও পড়ুন: শীতলক্ষ্যার তীরে গ্রামীণ মেলা
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া জেরিন ও জবা যমজ বোন। ঘুড়ি কিনতে নানা জহুরুল ইসলামের সঙ্গে এসেছেন মেলায়। ১০০ টাকা মূল্যর দুইটি ঘুড়ি কেনা শেষে জেরিন বলেন, প্রতিবার নানুর সঙ্গে এ মেলায় এসে ঘুড়ি কিনি। দুই বোনের কেউই ঘুড়ি উড়াতে পারি না তবে কিনতে ভালো লাগে। এবার বাড়িতে গিয়ে চেষ্টা করবো উড়ানোর।
ওবায়দুল হক বগুড়া শহরের একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার বাবা তোহা মিয়া পেশায় একজন আখের রস বিক্রেতা। বাবাকে সহযোগিতা করতে ১০০ টাকা মূল্যর ২১টি ঘুড়ি বিক্রি করতে মেলায় এসেছে সে। ওবায়দুল জানান, ঘুড়িগুলো বিক্রি করতে পারলে একটা মুরগি কেনার ইচ্ছে আছে। অনেকদিন বাবা বাড়িতে মুরগি আনেনি৷ এরপর বাকি টাকা বাবার হাতে দিয়ে দিব সংসারের কাজে।
৪৬ বছর বয়সী আজমল মিয়া ৩৫ বছর যাবত দারিয়ালের মেলায় ঘুড়ি বিক্রি করেন৷ যুগের সাক্ষী এ ঘুড়ি বিক্রেতা বলেন, মেলায় শুধু বেচাবিক্রি করতে আসি না। এর সঙ্গে আমার শৈশব ও মায়া জড়িত। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এ মেলায় ঘুড়ি বিক্রি করতে আসবো।
ঘুড়ির পরেই মেলায় নজর কেড়েছে বাহারি মিষ্টি দোকানগুলো। ১৫ পদের মিষ্টি শোভা পাচ্ছে দোকানগুলোতে। রস কদম, কুলফি, কালো জাম, পাতা মিষ্টি, ছানা জিলাপি, গোল্লা, স্পন্স, মৌচাক, নাটিম, লাল কদম, পোটল, কাটি, হাসি-খুশি, কাটারি ভোগ ও বড় মাছ। এবারের মেলায় সর্বোচ্চ ১০ কেজি ওজনের বড় মাছ মিষ্টির। বিক্রেতা দাম হাঁকছেন ৪ হাজার টাকা।
মিষ্টির দোকানের মালিক মিজানুর রহমান জানান, ১৫ পদের মিষ্টির দাম ২০০ টাকা কেজি থেকে শুরু। সব শ্রেণি পেশার মানুষের কথা ভেবেই মিষ্টিগুলো রাখা হয়েছে। এবারের বেচাবিক্রিও বেশ ভালো।
দারিয়াল গ্রামের জামাই মিলন হোসেন। পেশায় প্রকৌশলী এ ব্যক্তি জানালেন, ঈদে শ্বশুরবাড়ি না আসলেও হবে। তবে এ মেলায় না আসলে খবর ও লোকসান দুটোয় আছে। দাডিয়াল মেলার মধ্যে বসেছে ফলের হাট। গ্রীষ্মের পাকা কাঠাল, লিচু, আম, তরমুজ, জাম, তালের শাস সবই আছে এ মেলায়।
পাশাপাশি দারিয়াল মেলা বিখ্যাত কাঠের আসবাবপত্র বিক্রি ঘিরেও। এখানে খাট, শোকেজ, ডেসিনটেবিল, দরজা-জানালা, টেবিল ও চেয়ারসহ কাঠের তৈরি সবরকম আসবাবপত্রের পসরা বসেছে। তাজুল ইসলাম আদমদিঘী থেকে এসেছেন তার আসবাবপত্রের দোকান নিয়ে। তিনি জানান, এখনও এ বছর বেচাবিক্রি হয়নি। তবে তিনদিনের মেলায় আগামী দিনগুলো ভালোই বেচা হবে। প্রতিবারই প্রথমদিন সবাই এসে দেখে যায়।
নুনগোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম জানান, দারিয়াল প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো মেলা। প্রতিবছরই উৎসবের সঙ্গে এ মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এমেলাকে ঘিরে আশপাশের অর্ধশত গ্রামের মানুষ ঘুরতে আসেন।
আরএইচ/এএসএম