বৈরি পরিবেশে কমছে ব্যাঙ, হুমকিতে কৃষি পরিবেশ

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা পাবনা
প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ০৫ জুন ২০২৩

পাবনায় আশঙ্কাজনকহারে কমছে ব্যাঙের সংখ্যা। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে ব্যাঙ বিলুপ্তির পথে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে চরম হুমকির মুখে পড়বে কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। পরিস্থিতি না বদলালে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পুরো খাদ্য শৃঙ্খলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলনবিল, গাজনা (গণ্ডহস্তি), বিল কুড়ালিয়া, ঘঘুদহ বা বিল গ্যারকার মতো বড় বড় বিল সমৃদ্ধ পাবনা জেলা। ফলে দূর অতীত থেকেই এ অঞ্চল ব্যাঙে ভরপুর ছিল। ফসলি জমি এবং ধানক্ষেতেই প্রায় ১০ প্রজাতির ব্যাঙ দেখা যেত। এসব ব্যাঙের মধ্যে ছিল দুই প্রজাতির কোলা ব্যাঙ, কুনোব্যাঙ, কয়েক রকমের ঝিঝি ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ। কিন্তু গত দুই দশক থেকে ব্যাঙের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

jagonews24

এদিকে, দিনেদিনে জলাভূমি কমে যাওয়ায় সংকুচিত হচ্ছে ব্যাঙের আবাস। অন্যদিকে, চাষাবাদে কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে ব্যাপক হারে ব্যাঙ মরে যাচ্ছে। ব্যাঙ কমতে থাকায় অন্য প্রাণির খাদ্য উৎসেও সংকট তৈরি হচ্ছে। কারণ, অনেক জলজ প্রাণীর খাবার ব্যাঙ। ব্যাপক হারে ব্যাঙ কমে যাওয়ায় এসব প্রাণীর খাবারও কমে যাচ্ছে।

জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, বিগত বছরগুলোতে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ব্যাঙের প্রজননে প্রভাব ফেলেছে। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় থেকে বর্ষার পুরো সময়টা ব্যাঙের প্রজননের আদর্শ সময়। ব্যাঙাচি বেঁচে থাকার জন্য জমে থাকা পানি দরকার। কিন্তু চলতি বছরের মতো গত কয়েকবছরই অনাবৃষ্টি বা সময়মতো বৃষ্টি হয় না। এতে পানির অভাবে ব্যাঙাচিগুলো টিকতে পারছে না।

স্থানীয় প্রবীণরা জানিয়েছেন, আগেও পুকুরে মাছ চাষ হতো। তবে সেখানে বাইরের পানি বা বানের পানি ঢুকতো। কিন্তু এখন সুরক্ষিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়। এখন পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে ব্যাঙসহ সব রকম জলজ প্রাণি নির্মূল করার পর সেখানে মাছের পোনা ছাড়া হয়।

jagonews24

প্রবীণরা আরও বলছেন, আগে বিলে প্রায় ১২ মাসই পানি থাকত। কিন্তু এখন শীত আসতে না আসতেই বিল শুকিয়ে যায়। ফলে বিলগুলোতেও ব্যাঙ থাকতে পারে না। মাছ মারার সময়ও রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় এতেও ব্যাঙের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিকাজে পোকা দমনের জন্য কীটনাশক কিংবা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার ব্যাঙের জন্য ক্ষতিকর। এসব কীটনাশক ব্যবহারের ফলে যেসব পোকামাকড় মরে যায়, সেই সব মৃত বিষাক্ত পোকামাকড় পরবর্তীতে ব্যাঙ খেয়ে মারা যাচ্ছে। অথচ ব্যাঙ ফসলি জমির পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। সাধারণত ধানক্ষেতে ব্যাঙ থাকলে বাড়তি করে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষেতের ঘাস ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামী গাছ ফড়িং, পামরী পোকা এবং হলুদ মাজরা পোকা খেয়ে উপকার করে থাকে ব্যাঙ। মশা ও ছোট ছোট ক্ষতিকর জীবন্ত জীব খেয়ে জনজীবনের উপকার করে।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ব্যাঙের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটছে। এর প্রভাব পড়ছে গোটা পরিবেশের ওপর। মশা ও ফসলের অনিষ্টকারী কীট-পতঙ্গসহ বিভিন্ন প্রকারের পোকা-মাকড়ের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। যে কারণে একদিকে যেমন ফসলের দারুণভাবে ক্ষতি হচ্ছে অপরদিকে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারের ভ্যানচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘আগে রাস্তাঘাটে দ্যাখতাম সাঁঝ নামলিই গিরামে গিরামে এক দল মানষি পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, বস্তা আর জাল নিয়ে মাঠঘাট, পুকুর পাড়, জমির আইলে ঘুরে ব্যাঙ ধইরত। সেইসব ব্যাঙ চালান হতো কত জাগায়। দেখতি দেখতি ব্যাঙই হারায়ে গেল!’

আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘আগে বৃষ্টির রাতি ব্যাঙের ডাকে কান ঝালাপালা হয়া যাতো। এহন ব্যাঙই নাই, ডাকপি কিডা!’

jagonews24

পাবনার কৃষিকর্মী আব্দুল খালেক তার দীর্ঘ জীবনের প্রশিক্ষণ দানের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ব্যাঙ ক্ষেতের নিচের দিকের পোকা খায়। আর নিচের দিকে থাকে ফসলের ক্ষতিকর পোকা-মাকড়। ফসলি জমির ওপরের দিকে থাকে উপকারী পোকা। সে হিসেবে ব্যাঙ কৃষকের পরম বন্ধু।

তিনি বলেন, যথেচ্ছ কীটনাশক প্রয়োগ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে পাবনায় ব্যাঙ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এটা কৃষির জন্য খারাপ ইঙ্গিত বহন করছে।

পাবনার আটঘরিয়ায় খ্যাতিমান চাষি এবং আইসিএম প্রশিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, চাষির জন্য মহাউপকারী প্রাণী ব্যাঙ ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে আমরা চিন্তিত। এ বিষয়ে এখনই সরকারি উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

পাবনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র জানান, এ অঞ্চলে এখন বড় জোর ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির ব্যাঙ দেখা যায়। দুই দশক আগেও যেখানে ৩০-৪০ প্রজাতির ব্যাঙ ছিল। দিনদিন জেলায় জলাভূমি কমে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ। তীব্র খরার কবলে পড়ে অনেক প্রজাতির ব্যাঙই মারা গেছে বা যাচ্ছে। এভাবে দিনদিন এ অঞ্চলে ব্যাঙের প্রজাতি কমে গেছে।

কৃষি বিভাগের পাবনা জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্যাঙের মলমূত্রে বেশির ভাগই ইউরিয়া জাতীয় পদার্থ যা জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যাপক হারে পোকা দমন করতে পারার কারণে ব্যাঙকে ‘পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র’ বলা হয়ে থাকে। একটি এলাকার পরিবেশ কেমন, তা পরিমাপে ব্যাঙ সূচক হিসেবে কাজ করে। বড় সোনাব্যাঙ ও সবুজ ব্যাঙ ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এসব ব্যাঙ দেহের ওজনের অর্ধেক পরিমাণ পোকা প্রতিদিন খেতে পারে। এজন্য ব্যাঙকে কৃষক বন্ধু বলা হয়। সেই কৃষক বন্ধু ব্যাঙ হারিয়ে যাচ্ছে পাবনা জেলা থেকে।

jagonews24

তিনি বলেন, বড় বড় বিল অধ্যুষিত পাবনা জেলা থেকে ব্যাঙ কমে যাওয়া আতঙ্কের কথা।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, পাবনা চলনবিল অধ্যুষিত একটি জেলা। এ জেলাতে আরও অনেক ছোট-বড় বিল রয়েছে। বিলসমৃদ্ধ জেলা হওয়া সত্ত্বেও ব্যাঙ কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা মানুষের নানা কাজকর্ম ও প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে। পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব ব্যাঙ কমে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে এখনই সবার সচেতনতা দরকার।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. রাহেদুল ইসলাম বলেন, পাবনায় ব্যাঙ কমে যাচ্ছে। এর জন্য প্রাকৃতিক অবস্থা ও মানবসৃষ্ট কারণগুলো দায়ী। উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে কিংবা ছোট ছোট পুকুর খনন করা হচ্ছে। যে কারণে ব্যাঙের বসতি কমে যাচ্ছে। এছাড়া যথেচ্ছহারে কীটনাশক প্রয়োগের ফলেও ব্যাঙ মারা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, চাষিরা ক্ষতিকর কীট মারার জন্য বিষ প্রয়োগ করার ফলে ব্যাঙ মরছে। আবার ওই ক্ষেতের জমির পানি যখন অন্য জলাশয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে সেখানকার ব্যাঙও মারা যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা খাদ্য শৃঙ্খলে। অনেক দেশে মাছের খাদ্য হিসেবে আলাদা করে ব্যাঙ চাষ করা হয়। দেশেও এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

আমিন ইসলাম জুয়েল/এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।