গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করছে ডব্লিউবিসি

রাস্তার ধারে মুদিদোকান। দোকানি একজন নারী। দিনভর চলে বেচাকেনা। দোকানের ঠিক উল্টো পাশে বসতবাড়ি। পুরোনো সেই ভিটায় চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। আবার বসতভিটায় থাকা পুকুরে চলছে মাছচাষ। সঙ্গে গবাদিপশুও পালন করেন ওই নারী ও তার সহযোগীরা।
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত এলাকা সন্তোষপুরের নারী উদ্যোক্তা তপোতি রানী মজুমদারের জীবনের চাকা ঘুরছে এভাবে। এমন বহুমুখী কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে তিনি স্বাবলম্বী। তপোতির সংসার হয়ে উঠেছে এখন সোনায় সোহাগা।
অথচ কয়েক বছর আগেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন তিনি। কর্মবিমুখ স্বামীর কারণে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না তার। ওই সময় অধিকাংশ গ্রামীণ নারীর মতো তপোতি রানীও বিভিন্ন সামাজিক বাধার মুখে পড়েছিলেন।
কুল-কিনারা না পেয়ে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে নিজেই উইমেন বিজনেস সেন্টারের (ডব্লিউবিসি) উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। তার টিমে আরও চারজন নারী উদ্যোক্তাকে যুক্ত করেছেন তিনি। তাদের সামান্য পুঁজি নিয়ে প্রথমে গড়ে তোলা হয় একটি মুদিদোকান। এখন তপোতির মতো তাদেরও রয়েছে নিজস্ব কৃষিখামার।
তপোতি রানী মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুরুর সময়টা খুব কঠিন ছিল। পাঁচজন মিলে ডব্লিউবিসির সহায়তায় যখন দোকান করি, তখন অনেকে মন্দ কথা বলেছিল। গ্রামে মেয়েরা দোকান চালাবে, সেটা কেউ ভালোভাবে নেননি।’
তিনি বলেন, ‘এরপর যখন চাষাবাদ শুরু করি, তখনো পুরুষদের মতো কাজ করার চেষ্টাকে অনেকে উপহাস করেছে। তবে এখন আমরা সফল। সবাই আমাদের কাজকর্ম দেখতে ভিড় করেন। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দোকান দেখে যান। খামার থেকে সবজি, মাছ, দুধ কিনে নিয়ে যান।’
তপোতি বলেন, ‘আগে স্বামীর কাছে টাকা চাইলে নানা কৈফিয়ত দিতে হতো। এখন আমিই স্বামী ও সন্তানদের টাকা দিচ্ছি। নিজের ইচ্ছা হলে খরচ করতে পারছি। একটি গাড়ি কেনার স্বপ্ন আছে। আশা করছি, সেটাও পূরণ হবে।’
মাত্র তিন বছর হলো তপোতি রানীর এ উদ্যোগ। প্রথমদিকে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে কিছুটা সমস্যা পড়তে হয় তাকে। ব্যবসায় কিছু লোকসানও গুনেছেন। তবে এখন ব্যবসা বেশ ভালো। প্রতিমাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।
তপোতি স্বল্পশিক্ষিত। তবে পারিবারিক কারণে বিএ পাস করেও সেই অর্জনকে কোনো কাজে লাগাতে পারেননি আরেক নারী উন্নয়ন মণ্ডল। তিনিও এখন সন্তোষপুরের আরেক গ্রাম পিপড়াডাঙ্গায় ডব্লিউবিসির নারী উদ্যোক্তা।
তপোতির মতো আরও চারজন নারী উদ্যোক্তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ব্যবসা করছেন। তার দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদিপণ্যের পাশাপাশি রয়েছে চিংড়ি মাছের খাবার ও চাষের ঘেরের পানির পিএইচের মাত্রা পরীক্ষা করার সুবিধা। আবার বাড়ির খামারে একটি নার্সারিও রয়েছে তার।
উন্নয়ন মণ্ডল বলেন, ডব্লিউবিসি থেকে ফ্রিজার, ল্যাপটপ, পিএইচ টেস্ট কিট এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করা হয়। পাশাপাশি আমাদের বিপণন, টেইলারিং, কম্পিউটার অপারেটিং ও পিএইচ পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে, সেটা জেনে গেছি। আমরা লাভের অংশ দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসা বাড়াচ্ছি। অনেকে এখন আমাদের মূলধন দিতে চান। আবার কেউ কেউ পণ্য সরবরাহ করেন। বিক্রির পরে লাভ ভাগাভাগি করে নেন।
ডব্লিউবিসির এ উদ্যোগ বাগেরহাটের পাশাপাশি রয়েছে গোপালগঞ্জ, জামালপুর ও খুলনায়। ২০১০ সালে ফাইভ বাই টুয়েন্টি নামে একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ ঘোষণা করে কোকা-কোলা কোম্পানি। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ভ্যালু চেইনজুড়ে ৫০ লাখ নারী উদ্যোক্তার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন।
বৈশ্বিক প্রতিজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে ইউনাইটেড পারপাজের সহযোগিতায় গ্রামাঞ্চলে এসব উইমেন বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে দ্য কোকা-কোলা ফাউন্ডেশন। গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই যার উদ্দেশ্য।
জানা যায়, উদ্যোগটির প্রথমপর্যায়ে জামালপুর, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ৭০টি ডব্লিউবিসিতে এক লাখ নারীর জীবনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। পরোক্ষভাবে উপকৃত হন অন্তত চার লাখ মানুষ। বর্তমানে সুনামগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ জেলায় ৩০টি ডব্লিউবিসি নিয়ে এর দ্বিতীয়পর্যায় শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে ৪০ হাজার নারী উদ্যোক্তার ক্ষমতায়ন করা হবে।
কোকা-কোলা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সাদিয়া ম্যাডসবার্গ বলেন, ইউনাইটেড পারপাজের মাধ্যমে নারীদের ক্যারিয়ার, সম্পদ ও আত্মনির্ভরশীল জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে। মানুষের উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করার মতো একটি পরিবেশ তৈরি করাই সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ।
তিনি বলেন, বিজনেস সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তি, হাঁস-মুরগির খামার এবং নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ, ব্যবসা পরিচালনার জায়গা, এমনকি ডব্লিউবিসি থেকে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েও সহায়তা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কোকা-কোলা ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশন হলো- দ্য কোকা-কোলা কোম্পানির বৈশ্বিক জনহিতকর অঙ্গসংগঠন।
এনএইচ/এএএইচ/এএসএ/জেআইএম