অর্ণবের জরুরি খবর
ছোট্ট বয়স। পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে শুধু। কোনো বাঁধন-শাসনে তো সে বশ মানবে না। লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই। সারাদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করেই বেলা যায়। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে বহুদূর কলকাতায়। কোনোভাবেই সে পাখির জীবন, বন্ধু-পরিবার ছেড়ে যাবে না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। হয়তো বাবা-পরিবার ও বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সেই সময়টাতেই তার মনে এসেছিল ‘আমায় ধরে রাখো, আমায় বেধে রাখো’ গানের কথাগুলো।
সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি দুই বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তিনি। সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসেবেও আছে সুখ্যাতি। বলছি শায়ান চৌধুরী অর্ণবের কথা। আজ তার জন্মদিন। ১৯৭৯ সালের এইদিনে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন আধুনিক বাংলা সংগীতের নন্দিত ও জনপ্রিয় এই গায়ক। তার বাবা চিত্রশিল্পী স্বপন চৌধুরী, মা সুরাইয়া চৌধুরী। দেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী তপন চৌধুরী অর্ণবের চাচা এবং তার দুই কাজিন অভিনেত্রী রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা ও ইরেশ যাকেরের স্ত্রী জাকিয়া রশিদ মিম।
অর্ণব শব্দের অর্থ সমুদ্র। বড় হয়ে যেন সেই নামের যথার্থতা প্রমাণ করে গানের এক সমুদ্র হয়ে ওঠলেন এই সুরের যাদুকর। সুরের স্রোতে শ্রোতাদের ভাসিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অর্ণবের গানে মাটি ও মানুষের গন্ধ মিশে থাকে। লোকজ গানের প্রতি তার আলাদা দরদ টের পাওয়া যায়। তার গান প্রেমের, মিলনের, বিচ্ছেদের আড়ালে জীবনবোধের উঠোনে খেলা করে। সেজন্যই তার ‘হোক কলরব’ হয়ে ওঠে বিপ্লবের স্লোগান। তার গানের কথাগুলো হৃদয়কে আন্দোলিত করে। সেইসব কথায় লেগে থাকা সুর মনে হাহাকারের জন্ম দেয়, অনেকের ভিড়ে নিখোঁজ করে দেয়।
ছোট বয়স থেকেই গানের প্রতি ছিল তার দারুণ আগ্রহ। সেই আগ্রহের শুভযাত্রা হয় যখন তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। সেখানে পরিচয় ঘটে বন্ধু সাহানা বাজপেয়ীর সাথে। একসাথে গান গাওয়া, একে অপরের জন্য গানের কথা লেখা থেকে ভালোবাসা অতঃপর পরিণয়। পাশাপাশি বাড়তে থাকে দুজনের গানের চর্চা ও খ্যাতিও।

১৯৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অর্ণবের সংগীত ক্যারিয়ার। ভারতীয় বন্ধুদের নিয়ে অর্ণব ‘বাংলা’ ব্যান্ড গড়ে তোলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৮। এতে কিছুদিন পর যুক্ত হন আরেক শ্রোতানন্দিত শিল্পী আনুশেহ আনাদিল। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাংলা’ ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘কিংকর্তব্যবিমুঢ’। অ্যালবামটির গানগুলো তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল স্ফুলিঙ্গের মতো। সেসব গান আজও জনপ্রিয়। আর সর্বত্র ছড়িয়েছে অর্ণবের নামের রোশনাই।
২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় অর্ণবের প্রথম একক ‘চাই না ভাবিস’। পরের বছরই আসে তার তুমুল জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘হোক কলরব’। এরপর ২০০৮ সালে ‘ডুব’, ২০১০ সালে ‘রোদ বলেছে হবে’, ২০১২ সালে ‘আধেক ঘুমে’, ২০১৫ সালে ‘খুব ডুব’ এবং ২০১৭ সালে আসে তার ‘অন্ধ শহর’।
অর্ণব অডিওর পাশাপাশি সিনেমাতেও শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। তিনি ‘আহা!, ‘জাগো’, ‘মনপুরা’ ও ‘আয়নাবাজি’র মতো ভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমাগুলোতে গেয়ে এবং সংগীত পরিচালনা করে প্রশংশিত হয়েছেন। সম্প্রতি তিনি কোক স্টুডিও বাংলাতে যুুক্ত হয়েছেন প্রযোজক হিসেবে। তার প্রযোজনায় গেল দুটি সিজন বেশ জমজমাট কেটেছে সংগীতের আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজিটির। নতুন করে আবারও ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে কোক স্টুডিও বাংলা।
২০০১ সালে কলকাতার কণ্ঠশিল্পী শাহানা বাজপেয়ীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন অর্ণব। সে সংসার টিকেছিল সাত বছর। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। শাহানার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সুনিধির প্রেমে মজেন অর্ণব। ভারতের আসামের মেয়ে সুনিধি নায়েক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে স্নাতকোত্তর পড়েছেন। বিশ্বভারতীতে আয়োজিত ‘রবি অ্যান্ড র্যাবি’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে সুনিধির কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন অর্ণব। সেখান থেকে পরিচয়, এরপর তা প্রেমের সম্পর্কে রূপ নেয় এবং বিয়ে। ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর তারা বিয়ে করেন।
ব্যক্তিজীবনে খুবই চাপা স্বভাবের মানুষ অর্ণব। নিজের মতো করে চুপচাপ থাকতে ভালোবাসেন। তাকে পাওয়া যায় না রোজকার গড়পড়তার খবরের মিছিলে। একটা সময় মনে হতে থাকে নিখোঁজ হয়ে গেছেন তিনি। তবে হুট করে ফিরে এসে তিনি জানান দেন তার গানের ভাষতেই, ‘হারিয়ে যাইনি তবু, এটাই জরুরি খবর....’
আপাতত অর্ণব কোথাও ডুব মেরেছেন। শিগগিরই হয়তো ফিরবেন জরুরি কোনো খবর নিয়ে। সেই অপেক্ষা করা যাক।
এলআইএ/এএসএম