মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে লাতিন ফুটবল

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:২৯ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২২

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দুঃশাসনে শোষিত-নিষ্পেষিত, মঙ্গা পীড়িত এই জনপদের মানুষের খাদে পড়ে যাওয়া চোখে উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছিল ফুটবল। দেশভাগের পূর্বে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান, আর পরে আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ। একাত্তর পেরিয়ে এলো উত্তাল নব্বইয়ের দশক। বাংলাদেশের মানুষ তখন স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হাসতে ভুলে গেছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের মানুষও স্বৈরাচারের বিষাক্ত চাবুকের আঘাতে নীল হয়ে উঠেছে।

ঠিক সে সময় লাতিন আমেরিকার অ্যামাজন বন চিড়ে সাম্বার তালে তালে ফুটবল নিয়ে দৌড়ে আসছেন সোনালি রঙের ঝাঁকড়া চুল দোলানো এক ব্রাজিলীয় তরুণ মিডফিল্ডার। মাথায় বাঁধা রাবার ব্যান্ড-তাতে লেখা, ‘নিড জাস্টিস, নো টেরর, নো ভায়োলেন্স!’ তাঁর পেছন পেছন যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছুটে আসছেন লাতিন আমেরিকার মজলুম জনগণ! তরুণটি ডা. সক্রেটিস! একাধারে পেশাদার ফুটবলার, চিকিৎসক এবং ভীষণভাবে বিপ্লবী চিন্তাধারার মানুষ।

একই সময়ে ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনার অলিগলি দিয়ে ৬-৭ জনকে একা কাটিয়ে ক্ষিপ্র চিতার ন্যায় ছুটে চলেছেন ম্যারাডোনা! বামহাতে আঁকা চে’র ট্যাটু। হ্যান্ড অব গড, মাদকাসক্তির অভিযোগ, ফুটবল মাঠে মারামারিসহ বিভিন্ন অভিযোগ-অনুযোগ তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সবকিছু ম্লান হয়ে যায় তাঁর অনবদ্য ফুটবল মেধার কাছে। ম্যারাডোনা ছুটে চলেন সবকিছু পেছনে ফেলে। সাথে দুরন্ত সক্রেটিস, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হয়ে যায় এক টুকরো ফুটবল মাঠ! আর তাঁরা সে মাঠে ছুটছেন!

লাতিন থেকে হাজার হাজর মাইল পাড়ি দিয়ে তাঁরা এসে পড়লেন স্বৈরাচারের পদপিষ্ট হয়ে হাসতে ভুলে যাওয়া মানুষদের দেশ বাংলাদেশে। পাড়া-মহল্লায় শোর পড়ে গেল, বরণ করে নিল তাঁদের মতোই নিষ্পেষিত আরেকটি জনপদের মানুষকে, তাঁরা লাতিন অঞ্চলের মানুষ, ফুটবলকে তাঁরা হৃদয় দিয়ে খেলেন।

মূলত ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ থেকে গ্রাম্য বাজারগুলোয় বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার প্রচলন শুরু হয়, কোনো কোনো বাজারে একটি অথবা সর্বোচ্চ দুটি সাদা-কালো টেলিভিশন দেখা যেত। আর টেলিভিশনগুলো চায়ের দোকানে দেখা যেত বেশি। দুটি সারিতে ছয়-সাতটি কাঠের বেঞ্চ পাতা থাকত। চা-বিস্কুট খাওয়ার শর্তে অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে চায়ের দোকানগুলোয় খেলা দেখানো হতো।

তেমনই একটি গ্রাম্যবাজার চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ বাজার। আমিনুর রহমান চৌধুরী এ এলাকারই বাসিন্দা। নব্বইয়ের দশকে বাজারে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আশি এবং নব্বইয়ের দশকে আমরা জোরারগঞ্জ বাজারে মাদল হক সওদাগর ও ভোলা সওদাগরের চায়ের দোকানে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতাম। তখন তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিটিভি বিশেষ কিছু খেলা সম্প্রচার করত। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দর্শকরা চায়ের দোকানে উপস্থিত হতেন।’

তিনি বলেন, ‘এক পিস পাউরুটি এবং এক কাপ চা খেয়ে দোকানের ভেতরে বসে খেলা দেখার সুযোগ মিলত। আর যারা খরচটি করতে পারতেন না অথবা ভেতরে বসা কিংবা দাঁড়ানোর সুযোগ পেতেন না, তাদের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হতো। তখনও পতাকা ওড়ানোর সংস্কৃতি চালু হয়নি। আমাদের এলাকায় ব্রাজিল সমর্থক বেশি দেখা যেত। কিন্তু ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার অসাধারণ নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জেতার পর ব্রাজিলের পাশাপাশি আর্জেন্টিনার সমর্থকও বাড়তে শুরু করে।’

একই সময়ে ইউরোপের জয়জয়কার চলছে ফুটবলে। একদিকে ডাচদের রুড গুলিত, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, মার্কো ভ্যানবাস্তেন; অন্যদিকে ইতালির পাওলোরসি, ফ্রান্সের মিচেল প্লাতিনি, জার্মানির লোথার ম্যাথিউস, রুডি বয়লার, জার্গনে ক্লিন্সম্যান কেউই পারেননি এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে, সক্রেটিস-ম্যারাডোনারা পেরেছিলেন। নামিদামি কোচ-ছকে বাঁধা ইউরোপীয় পাওয়ার ফুটবল, পৃথিবীর শীর্ষ সব ফুটবল লীগ, তাবড়-তাবড় ধনী ক্লাব-অর্থের ছড়াছড়ি থমকে যায় বাংলাদেশের লাতিন ফুটবল ভালোবাসার কাছে।

ফুটবলের চুলচেরা বিশ্লেষণ খুব কম মানুষই করতে পারতেন সে সময়। লাতিন ফুটবলারদের একক নৈপুণ্য এই জনপদের মানুষের নির্মল আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে। পত্রিকার প্রথম পাতা দখল করে নেওয়া মিছিল, লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস পেরিয়ে খেলার পাতায় সক্রেটিস, ম্যারাডোনার ছবিতে চোখ আটকে যায় মানুষের। ফসলের ক্ষেতে কোদাল চালানো রুক্ষ হাতে মৃদুস্পর্শ করে সে ছবি, অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ফুটবল!

লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।