শি জিনপিং-পুতিনের সঙ্গে বৈঠক, এসসিও সামিট থেকে কী পেলেন মোদী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৪১ এএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নরেন্দ্র মোদী, ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং/ ছবি: এএফপি

চীনের তিয়ানজিনে দুই দিন ব্যাপী সফর শেষে সোমবার রাতে দিল্লিতে ফিরে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি সেখানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) জোটের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা চড়া হারের শুল্ক মোকাবিলায় ভারতকে যখন কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই সফরকে ভারতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছিল।

এই সফরের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশ্যই ওয়াশিংটনকে একটি কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন।

নিজের অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে করা পোস্টে নরেন্দ্র মোদী লিখেছেন, চীনে একটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলাম। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেছি।

তিনি আরও লিখেছেন, সম্মেলন সাফল্যের সঙ্গে আয়োজন করার জন্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, চীনা সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাই।

চীন, রাশিয়া ও ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ‌‌এসসিওকে পশ্চিমা বিশ্বের জোট ন্যাটোর বিকল্প একটি মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আবার নানা কারণে এসসিওতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে ভারতের নানা দ্বিধাও কাজ করেছে।

এর আগের বেশ কয়েকটি এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে নিজে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরকে। কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তিনি নিজেই সশরীরে তিয়ানজিনে গিয়েছেন। গত সাত বছরের মধ্যে চীনে এটাই ছিল তার প্রথম সফর।

শি জিনপিং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক
রোববার সফরের প্রথম দিনেই শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ভারত-চীনের সহযোগিতা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। পৃথিবীর ২৮০ কোটি মানুষ যে এই দুটো দেশে থাকে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট শি বার্তা দেন, বিশ্ব আজ একটি রূপান্তরের পথে। এশিয়ার ড্রাগন আর হাতি একসঙ্গে এগোলে তা হবে সময়ের দাবি। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বের দুই প্রাচীনতম সভ্য দেশ এবং সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। আমাদের পরস্পরের বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশী হয়ে একসাথে এগোতে হবে।

চীন ও ভারত যে পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগিতার অংশীদার-সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদী আরও জানান, ভারত ও চীনের মধ্যে সরাসরি বিমান পরিষেবা অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তা বন্ধ ছিল।

রাশিয়া-ভারত-চীন ‘ট্রয়কা’?
ট্যারিফ নিয়ে আমেরিকার চাপ মোকাবিলায় ভারত এখন চাইবে চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি আসতে, এমন একটা ধারণার কথা সম্প্রতি বহু পর্যবেক্ষকই বলেছেন।

এসসিও সামিটের দ্বিতীয় দিনে দেখা গেছে যে, নরেন্দ্র মোদী, ভ্লাদিমির পুতিন ও শি জিনপিং তিনজনে একসঙ্গে মিলে সৌহার্দ্যের এক বিরল দৃশ্য তুলে ধরেছেন। তিন বিশ্বনেতার মধ্যে করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাসি-রসিকতা বিনিময়ের মাধ্যমে তিয়ানজিনে এক বিরল অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয়।

এরপরই নরেন্দ্র মোদী এক্সে এক পোস্টে লেখেন, তিয়ানজিনে কথোপকথন অব্যাহত! প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে মতবিনিময়।

অন্য আর একটি পোস্টে তিনি লেখেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা হওয়াটা সব সময়ই আনন্দের।এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চের একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, নরেন্দ্র মোদী স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুতিন ও শিকে কাছে টেনে এনে ঐক্যের প্রতীকী বার্তা দিতে চাইছেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী দৃশ্যতই তাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন। সম্মেলনে একটা পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের হাত ধরে হাঁটছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ঠিক সেই মুহুর্তে তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।

কিন্তু মোদী বা পুতিন কেউই তার দিকে চোখ তুলে তাকাননি এবং শেহবাজ শরিফও সেদিকে এগোননি।
ভারত ও পাকিস্তান মাত্র কয়েক মাস আগেই পরস্পরের বিরুদ্ধে সামরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, যে যুদ্ধ থামানোর ‌কৃতিত্ব কার তা নিয়ে কূটনৈতিক জলঘোলাও কম হয়নি।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বার্তা
সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে এসসিও সদস্য রাষ্ট্রগুলো গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। ওই হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা ব্যক্ত করা হয় এবং হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়।

যদিও ওই হামলার জন্য কোনো গোষ্ঠী বা দেশকে অভিযুক্ত করা হয়নি, তারপরও ঘোষণাপত্রে পহেলগামের অন্তর্ভুক্তিকে ভারত একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছে।

এসসিওর পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, সন্ত্রাসবাদ শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে হুমকি। এর বিরুদ্ধে দ্বিমুখী নীতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সেই সঙ্গেই তিনি আরও যোগ করেন, যে দেশগুলো প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে অবস্থান নিতে হবে। মানবতার স্বার্থে সন্ত্রাসবাদের সব ধরনের রূপকে রুখে দিতে হবে।

এর আগে পহেলগাম হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল এবং ওই হামলার প্রায় ১৫ দিন পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন সিন্দুর অভিযান শুরু করেছিল। তবে এসসিওর মঞ্চে তিনি সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।

চীনের বিরুদ্ধেও পরোক্ষ বার্তা
চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে ভারত তাদের আপত্তির বিষয়টিও প্রচ্ছন্নভাবে তিয়ানজিনে তুলে ধরেছে।

বিআরআই প্রকল্প যেহেতু পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যায় এবং সেটাকে ভারত নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে থাকে তাই চীনের এই প্রকল্পটিকে ভারত নিজেদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখে।

সে কারণেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, সংযোগ তখনই অর্থবহ, যখন তা সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে। অন্যথায় সেটা কিন্তু আস্থা হারায়।

পাশাপাশি তিনি এটাও জানান, ভারত চাইছে ইরানের চাবাহার বন্দর ও উত্তর-দক্ষিণ আন্তর্জাতিক করিডরের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে টেঁকসই একটি কানেক্টিভিটি বা সংযোগ স্থাপন করতে।

ইরানের এই চাবাহার বন্দরটি প্রধানত ভারতের অর্থায়নেই নির্মিত হয়েছে, যেটাকে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে ভারত তাদের গেটওয়ে বা প্রবেশমুখ হিসেবে দেখছে।

মোদী-পুতিনের গোপন কথোপকথন
এসসিও সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে একই লিমুজিনে চাপেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। গাড়ির পেছনের সিটে দুজনে পাশাপাশি বসে তারা শহরের রিটজ কার্লটন হোটেল অভিমুখে রওনা হন, যেখানে দুই নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

পথে প্রায় এক ঘণ্টা তারা একান্তে কথাবার্তা বলেন। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম বলছে, এই কথাবার্তা ছিল একেবারেই গোপন, যা অন্যদের কানে পৌঁছানোর জন্য নয়। নরেন্দ্র মোদী এবং ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বিশেষ ও সুবিধাজনক ‌কৌশলগত অংশীদারিত্ব (স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ) জোরালো করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

আলোচনা হয় ইউক্রেন সংকট নিয়েও। নরেন্দ্র মোদী ওই যুদ্ধের ব্যাপারে বলেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে গঠনমূলক পথে এগোতে হবে। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আগামী ডিসেম্বর মাসে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেন।

নরেন্দ্র মোদী বলেন, ১৪০ কোটি ভারতীয় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্রেমলিন অবশ্য আগেই জানিয়েছে, এই সম্মেলনে যোগ দিতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ডিসেম্বরে ভারত সফর করবেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।