কেমন যাবে নতুন বছর
আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ডলারের আধিপত্য
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সাধারণত দুর্বল ডলার বা ডলারের দরপতন স্বস্তির খবর বয়ে আনে। কারণ, দরিদ্র দেশগুলো ধনী দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন ডলারে বেশি ঋণ নেয়। ফলে এর মান কমলে তাদের ঋণের চাপও হালকা হয়। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে অন্যান্য উন্নত দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান প্রায় ১০ শতাংশ কমেছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিকরা বরং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
এর মূল কারণ, ডলারের এই পতন এসেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ ঘিরে বাজারের প্রতিক্রিয়ার ফলে। ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্যের প্রচলিত নিয়মকানুন কার্যত ছুড়ে ফেলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর কঠোর শুল্ক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেন। এর ফলে অনিশ্চয়তা বেড়ে যায় এবং ঝুঁকি প্রিমিয়াম (উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণের জন্য যে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয়) উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ডলার দুর্বল হলেও ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ডলারে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে যায়।
তবে বাস্তবে শুল্কের ধাক্কা অনেকের আশঙ্কার চেয়ে তুলনামূলক কম ছিল। অনেক পণ্য ছাড় পাওয়ায় বর্তমানে গড় হিসাবে দেশগুলোর রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ হচ্ছে প্রায় ১৮ শতাংশ, যেখানে ট্রাম্প একসময় সার্বিকভাবে ৩০ শতাংশ শুল্কের কথা বলেছিলেন। তবু ডলার এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ডলারে ঋণ নেওয়ার খরচ রয়ে গেছে চড়া। ফলে বিকল্পের সন্ধানে নেমেছে অনেক দেশ।
আরও পড়ুন>>
রিজার্ভ বেড়ে ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার
ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির রেকর্ড পতন
ডলারের শক্তি বাড়াতে গিয়ে উল্টো ক্ষতি করেছেন ট্রাম্প
ঝুঁকিতে ডলারের আধিপত্য
বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের নিরাপত্তা ও আধিপত্য কয়েক দশক ধরেই ধীরে ধীরে কমছে। প্রশ্ন উঠছে, ২০২৬ সালে কি এই পরিবর্তনের গতি আরও বাড়বে?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ডলারে লেনদেন তুলনামূলক সহজ ও সস্তা, কারণ তাদের ঋণ ও বাণিজ্যের বড় অংশই এই মুদ্রায় হয়। কিন্তু ট্রাম্পের নীতির কারণে ডলারে বাণিজ্য ও ঋণ—দুটোই কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আফ্রিকায় চীনের রপ্তানি বেড়েছে এক-চতুর্থাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেড়েছে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
সাধারণত দরিদ্র দেশগুলো তাদের বাণিজ্যের ধরন অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ ধরে রাখে। এই প্রবণতা যদি ২০২৬ সালেও চলতে থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বড় পরিসরে ডলার বিক্রি করে অন্য মুদ্রা কিনতে পারে।
এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে কিছু দেশ নানা প্রণোদনাও দিচ্ছে। রিজার্ভ মুদ্রার দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ সুবিধা ভোগ করে—তাদের ঋণ তুলনামূলক কম সুদে নেওয়া যায়।
ডলারের বিকল্প কী?
এই সুবিধাকে চ্যালেঞ্জ করতে চীন তার বড় বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য মুদ্রা অদলবদল বা ‘সোয়াপ লাইন’ চালু করেছে। ৪০টির বেশি দেশ এরই মধ্যে জরুরি রিজার্ভ হিসেবে ইউয়ান ব্যবহারের সুযোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়া, ভারতসহ ব্রিকস জোটের দেশগুলোর সঙ্গে চীন এমন একটি ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, যেখানে ডলারের প্রয়োজন নেই। কর্মকর্তাদের দাবি, ২০২৬ সালেই এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যেতে পারে।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে ডলারের অংশ কমেছে। বিশ্বজুড়ে মোট বৈদেশিক রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশ এখন ডলারে রাখা হচ্ছে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে ডলারের আধিপত্য আরও ভাঙা হয়তো সহজ হবে না। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ লেনদেন এখনো ডলারে হয়। আর বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ এক-দশমাংশের কম হলেও, বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক এখনো ডলারে নিষ্পত্তি হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ডলারকে সত্যিকার অর্থে সরাতে হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২৫ সালের চেয়েও বড় ধাক্কা লাগতে হবে। ২০২৬ সালে সেই ধাক্কা আসবে কি না—সেদিকেই তাকিয়ে বিশ্ব।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/