তারা `বাঁচাও বাঁচাও` বলে চিৎকার করছিল


প্রকাশিত: ০৩:২২ পিএম, ১৯ মে ২০১৫

মায়ের কাছে ফিরে আসার আকুলতা এখন বাংলাদেশি কিশোর আবসারুদ্দিনের কণ্ঠে। মানবপাচারের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন সাগরে ভাসমান থাকার পর সম্প্রতি উদ্ধার হয় ১৪ বছর বয়সী আবসারুদ্দিন। তাকে সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধার করেন কিছু ইন্দোনেশিয়ান জেলে। আন্দামান সাগরে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাসমান থাকার পর যারা ওই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছেন তাদের এখন ওই দিনগুলো যেন হয়ে উঠেছে দুঃসহ স্মৃতি।

আবসারুদ্দিন জানায়, নৌকার কর্মীরা তার চাচা মাইনুদ্দিন (১৬) এবং অপর এক আত্মীয় নবী হোসেনকে (১৮) হত্যা করেছেন। ক্ষুধায় মাইনুদ্দিন নৌকার কর্মীদের কাছে খাবার চাইতে গেলে তাকে মারধর শুরু করেন কর্মীরা। নবী হোসেন প্রতিবাদ জানালে তাকেও পেটাতে শুরু করে তারা। বিরোধের এক পর্যায়ে তাদেরকে সাগরে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

`আমি শুনছিলাম তারা `বাঁচাও! বাঁচাও!` বলে চিৎকার করছিল। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি। শুধু কাঁদছিলাম এবং প্রার্থনা করছিলাম।` বলেন আবসারুদ্দিন।

সাগরে ভাসমান নৌকায় থাকা মানুষগুলোর ভয়াবহ সে অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করা এই কিশোর। আবসারুদ্দিন বিবিসিকে জানায়, তাকে জোর করে নৌকায় করে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হচ্ছিল। প্রথমদিকে নৌকায় তাদের ভালোই খাবার দেয়া হচ্ছিল। দিনে দুইবেলা ভাত এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে খাবারের অভাব দেখা দিলে তাদেরকে বিস্কুট এবং সাগরের লবণাক্ত পানি পানে বাধ্য করা হয়। খাবারের অভাবে প্রায় মরে যেতে বসেছিল সে। তার ক্ষুধার্ত আত্মীয়দেরকে সাগরে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করা হয়। তাকেও ক্ষুধার্ত অবস্থায় জোর করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। পরে উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে তাকেসহ প্রায় ১০০ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করেন সেখানকার জেলেরা।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে আবসারুদ্দিন বারবারই কান্নায় ভেঙে পড়ছিল এবং তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইছিল।

নৌকায় ওঠার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আবসারুদ্দিন বলে, সে তার দুই আত্মীয়ের সঙ্গে সকালবেলা টেকনাফে নাস্তা করতে গিয়েছিল। এমন সময় কিছু অপরিচিত মানুষ এসে তাদেরকে একটি বাগানে নিয়ে যান। সেখানে একটি গাছের সঙ্গে তাদের বেঁধে রাখা হয় এবং মারধর করা হয়। পরে সেখান থেকে তাদেরকে একটি জনবহুল নৌকায় তুলে নেয়া হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদেরও লাংসা শহরে আলাদা আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তাদের সকলের অভিজ্ঞতাই ভয়াবহ এবং নির্মম।

এদিকে খাবার সঙ্কট দেখা দেয়ায় নৌকায় বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই নিজের আধিপত্য দেখাতে চাচ্ছে এবং প্রায়শই কাউকে না কাউকে সাগরে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। আবসারুদ্দিন জানায়, নৌকায় খাদ্যাভাব দেখা দিলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশিদের উপর চড়াও হন। বন্দুক এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সাগরে ছুঁড়ে ফেলতে থাকেন।

অন্যদিকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে তৈয়ব আলী নামের এক রোহিঙ্গা জানান, বাংলাদেশিরাই আসলে রোহিঙ্গাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা রোহিঙ্গাদের সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করেন। এখন পর্যন্ত আবসারুদ্দিনের মতো এমন হাজারো অভিবাসীকে সাগর থেকে উদ্ধার করা হলেও এখনো হাজার হাজার অভিবাসী প্রচণ্ড খাদ্য সঙ্কটে সাগরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছেন।

ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় অনেক অভিবাসীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সাগরে অসহায় অবস্থায় ভাসমান নাগরিকদের আশ্রয় দিতে নিকটবর্তী দেশগুলোকে চাপ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রও বেশ কয়েকবার দেশগুলোকে মানবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সাগরে ভাসমান এ নাগরিকদের অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ, তা আবসারুদ্দিনের অভিজ্ঞতায় ফুটে উঠেছে। তবুও মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় নৌবাহিনী তাদের নৌকাগুলোকে সীমান্তে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।

বিভিন্ন দেশ অভিবাসীদের নিয়ে খেলছে উল্লেখ করে একে ‘হিউম্যান পিং পং’ হিসেবে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। এদিকে আন্দামান উপকূলে এখনও ভাসছে হাজার হাজার অভিবাসী ভর্তি নৌযান। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। তাদের উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বান তোয়াক্কাই করছেনা ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া।


ইন্দোনেশিয়ার আচেহতে পৌঁছা বাংলাদেশি মোহাম্মদ রফিক একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, যাত্রাপথের লোমহর্ষক সব ঘটনার কথা। তিনি বলেছেন, খাবার নিয়ে তাদের নৌকাতেই মারামারি হয়েছিল। এতে অন্তত ১শ জন নিহত হন। তাদের কাউকে কাউকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে কাউকে নৌকা থেকে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। ফাঁসি দেয়া হয়েছে।

এমন অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইয়োধোয়োনোর ডেমক্রেটিক পার্টির (পিডি) এমপি রুহুত মিতোমপুল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি বোটবোঝাই অভিবাসীদের মানবিক সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আচেহ ও উত্তর সুমাত্রার মধ্যে এখনও অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছে। এসব মানুষের দিকে আরও সুনজর দেয়া উচিত ইন্দোনেশিয়ার।

থাইল্যান্ডে  বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন হেডের সঙ্গে মঙ্গলবার সকালে মালয়েশিয়া সময় ১১টায় ফোনে কথা হলে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী ভর্তি আরও নৌকা ইন্দোনেশিয়ার দিকে যাচ্ছে। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জেলেরা বলেছে, তারা কমপক্ষে দুটি নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের দিকে যেতে দেখেছেন। অভিবাসী বোঝাই নৌযানকে তাড়িয়ে দিতে ইন্দোনেশিয়া তিনটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি বিমান মোতায়েন করেছে। এ সপ্তাহান্তে একটি নৌযান ইন্দোনেশিয়া ভেড়ার চেষ্টা করলে সে দেশের নৌবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করে।

ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ফুয়াদ বাসিয়া বলেন, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে অভিবাসীবাহী নৌযানকে ঠেকাতে মোট চারটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি বিমান টহল দিচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে মালাকা প্রণালী দিয়ে একটি নৌযান এগিয়ে যেতে থাকলে গত সোমবার তাদের থামিয়ে দেয় তারা। ওই বোটের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগের পর বোটটি ইন্দোনেশিয়ার দিকে ফেরত পাঠানো হয়।

সোমবার মিয়ানমারে ৭ বাংলাদেশিকে উদ্ধার বিষয়ে কোস্ট গার্ড স্টেশন কমান্ডার ডিকসন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের মাছধরা নৌকা দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা হয় ওই বাংলাদেশিকে। এরপর তাদের বাংলাদেশের জেলেদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারাই কোস্টগার্ডদের খবর দিয়েছেন বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ভর্তি তিনটি বোট সম্পর্কে।

এমজেড/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।