জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ

‘গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:১৪ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২৫
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া/ ফাইল ছবি

জুলাই আন্দোলনের সময় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি পেশ করেছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

তিনি জানান, এই জ্বালাও-পোড়াওকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয়।

রাষ্ট্রপক্ষের ১৯তম সাক্ষী হিসেবে প্রথম দিনের মতো বৃহস্পতিবার জবাবন্দি পেশ করেন তিনি। এরপর এ বিষয়ে পরবর্তী জবানবন্দি পেশ করার জন্য আগামী ১৬ অক্টোবর দিন ঠিক করেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ জানান, আমার নাম আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বয়স আনুমানিক ২৭ বছর। আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলাম। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। ২০১৮ সালে এই কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলন ব্যাপক মাত্রায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চাপে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালের আন্দোলনেও আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।

তিনি জানান, কোটা বাতিলের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। ২০২৪ সালে ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে রায় দেন। এই রায়ের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করি। এরপর কোরবানির ঈদের ছুটি হয়ে যায়। আমরা কোরবানির ঈদের পর ১ জুলাই থেকে পুনরায় আন্দোলন শুরু করি।

সজীব ভূঁইয়া বলেন, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও জেলা শহর পর্যায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলছিল। ১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেই। সেদিন সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়। এর প্রতিবাদে ওইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হলসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা হলের গেটের তালা ভেঙে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একত্রিত হয়। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে- স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে এবং তখন থেকে আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়।

তিনি আরও জানান, পরদিন ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান। তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গুরুতর আহত হন। আহত শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে।

এই হামলার প্রতিবাদে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। সেদিন শহীদ মিনারে আন্দোলনরত অবস্থায় আমরা জানতে পারি যে, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরে জানতে পারি সেদিন চট্টগ্রামের ওয়াসিমসহ সারাদেশে সর্বমোট ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হন।

১৭ জুলাইয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করি। তখন আর এ আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা হয়ে যায় সর্বজনীন। রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালনের পূর্বেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেখান থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেনসহ দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজা পালন করি।

তিনি বলেন, জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর দিকের হলপাড়ার দিকে আবদ্ধ হয়ে যাই। সেদিন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদসহ শতাধিক আন্দোলনকারী পুলিশের হামলায় আহত হন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর আমরা জাতীয়ভাবে কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেই এবং পরদিন ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করি। সেদিন দেশব্যাপী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলি বর্ষণ করে। সেদিন সারাদেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পাই।

তিনি বলেন, আন্দোলনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। সেদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।

এফএইচ/এমআইএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।