লুটপাটকারীদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা কেন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ০৬ অক্টোবর ২০২১

করোনা মহামারিতে প্রণোদনার নামে ফাঁদ পেতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

আদালত বলেছেন, লুটপাটকারীদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের (দিনমজুরদের) বিরুদ্ধে মামলা করা হলো, এর কী কারণ?

প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টার অভিযোগের মামলায় পাঁচ দিনমজুরের জামিন আবেদন শুনানিতে বুধবার (৬ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মাদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ অসন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি এ মন্তব্য করেন।

শুনানি শেষে আদালত ওই পাঁচ দিনমজুরকে এক বছরের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।

এদিন আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত।

শুনানির শুরুতে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আমি যাদের জামিন আবেদন নিয়ে এসেছি, তারা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষ। তাদের বাড়ি কুগিগ্রামে। তাদের করোনার প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, এভাবে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।

তখন আদালত বলেন, মামলা তো হয়েছে গাজীপুরে। তারা জেলে আছেন কতদিন?

তখন আইনজীবী বলেন, তারা গত ৩ জুলাই থেকে জেলে আছেন। তাদের কোনো অবলম্বন নেই। তাদের বাঁচার উপায় নেই।

তখন জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত বলেন, এটা ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মামলা।

জবাবে হাইকোর্ট বলেছেন, যারা লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো না। দিনমজুর সাধারণ মানুষকে কেন ফাঁসানো হল? এরপর আদালত প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে কারাগারে যাওয়া কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবস গ্রামের দিনমজুর বিধবা ফুলমনি রানী, রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র রায় ও নিখিল চন্দ্র বর্মণকে এক বছরের জামিন দেন।

এ সময় আদালত আরও বলেন, যারা লুটপাট করলো তাদের বিরুদ্ধে মামলা না হয়ে গরিব মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হলো, কারণ কী? লুটপাটকারীদের পরিবর্তে সাধারণ কৃষককে কেন ফাঁসানো হলো?

গত রোববার (৩ অক্টোবর) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির পাঁচ দিনমজুরের পক্ষে জামিন আবেদন করেন।

ওই পাঁচ দিনমজুর হলেন- কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবাঁস গ্রামের বিধবা ফুলমনি রানী, রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র রায় ও নিখিল চন্দ্র বর্মণ। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়ে চারজন কারাগারে আছেন।

গত ১৫ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে ‘করোনা প্রণোদনার নামে প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে ৪ দিনমজুর কারাগারে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে গত ১ জুলাই দুই সরকারি কর্মকর্তাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় মামলাটি করেন সোনালী ব্যাংকের শ্রীপুর হেডকোয়ার্টার শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল হক।।

সরকারি ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা আত্মসাৎ চেষ্টার এ মামলায় গাজীপুর থানা পুলিশ ২ জুলাই চার দিনমজুরকে তাদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। অপরজন দিনমজুর পলাতক রয়েছেন।

অভিযুক্ত পাঁচ দিনমজুরের পরিবারের দাবি, করোনা প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। টাকা আত্মসাতের সঙ্গে তারা জড়িত নন। দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।

মামলায় গ্রেফতার চারজন ও পলাকত একজনসহ শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ, হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর আরিফুর রহমান, মাস্টাররোল কর্মচারী তানভীর ইসলাম স্বপন ও ঢাকার উত্তরখান জামতলা এলাকার বাসিন্দা শাহেনা আক্তারকে আসামি করা হয়।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা নদীর পাড়ে বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবাঁশ গ্রামের বাসিন্দা ওই পাঁচ পরিবার বলছে, সরকারি টাকা আত্মসাৎকারী একটি চক্রের প্রতারণার কারণে তাদের ভাগ্যে এমন বিপদ নেমে এসেছে। বসতভিটা ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পদ নেই।

বাড়ি ছাড়া দিনমজুর সুবল চন্দ্র মোহন্তের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, তারা গাজীপুর ও শ্রীপুরে কোনোদিন যাননি। তানভীর ইসলাম স্বপনই তাদের নিয়ে গেছেন। তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তারা প্রণোদনার টাকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এর মধ্যেই পুলিশ এসে চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এসময় তিনি বাড়ির বাইরে ছিলেন।

সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখার ব্যবস্থাপক শরিফুল আজম জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংক হিসাব চালুর কিছুদিন পর এই পাঁচ দিনমজুরের হিসাব নম্বরে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা চলে আসে। এর মধ্যে রণজিতের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রবাসের ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা, সুবলের ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমলের ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ফুলমণি রানীর হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা আসে।

তিনি জানান, কয়েক দিন পর অপরিচিত তিন-চারজন লোক এসব হিসাব নম্বর থেকে টাকা তুলতে এলে তার সন্দেহ হয় এবং শ্রীপুর হেডকোয়ার্টার শাখায় যোগাযোগ করে টাকা উত্তোলন বন্ধ করা হয়। কিন্তু অপরিচিত লোকগুলোকে আটক করার আগেই তারা ব্যাংক থেকে সরে যায়।

হিসাব নম্বরধারী দিনমজুররা এসবের কোনো কিছুই জানতেন না বলে জানান শরিফুল আজম।

ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজীব কুমার রায় জাগো নিউজকে বলেন, এটি শ্রীপুর থানার ঘটনা। শ্রীপুর থানা পুলিশই ব্যবস্থা নেবে। তাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হলে তারা বিস্তারিত জানাবেন।

এফএইচ/এমকেআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।